সময়ের ব্যবধান

0
172

সোমা প্রতিদিন খুব ভোরে এসে জানালার পাশে দাঁড়ায়, উদ্দেশ্য তার একটাই বিলাশবহুল অট্রালিকায় পাশে ছোট্ট খুপরি ঘরে বসবাস করা মতিমিয়ার সংসার দেখা।

শুধু মতি মিয়ার সংসারই নয়, তার দক্ষিণের ঝুল বারান্দায় একজোড়া চড়ুই দম্পতি এসে বাসা বেঁধেছে এক ফাঁকে তাদের খুনসুটি ভরা সংসারও দেখা।

কাজে যাওয়ার আগে প্রতিদিন ভোরে মতি মিয়া গোসল করে।  উঠানের এক কোণে বসানো চাপা কলে পানি ভর্তি করে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে মতি মিয়ার  স্ত্রী।

তার মুখে দুষ্ট-মিষ্টি হাসি। মতি মিয়া বালতি থেকে এক আঝলা পানি নিয়ে ছিটিয়ে দেয় স্ত্রীর গায়ে। স্ত্রীর কাঁধে থাকা লুঙ্গি গামছা ভিজে জবজবে হয়ে যায়।

এক সময় তারা হেসে লুটোপুটি খায়। তাদের হাসির শব্দ নিচতলা থেকে হাওয়া ভেসে ভেসে এসে সুর তোলে সোমার কানে। তারা দু’জন দু’জনের দিকে পানি ছিটিয়ে দেয়। মতি মিয়ার স্ত্রীর হাস্যোজ্জ্বল চোখ, মুখ দেখে বুঝা যায় মেকি অভিমান করলেও স্বামীর সাথে একই সময়, একই সাথে গোসল করতে পেরে সে নিজেও আনন্দিত।

ভোরের আলো চারদিক আলোকিত করার আগেই এই পবিত্র, স্নিগ্ধ দৃশ্যটা এসে ধরা পড়ে সোমার চোখের ফ্রেমে।

সোমার চোখের কোণে অশ্রু জমে। অবাধ্য অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ার জন্য বিদ্রোহ করে। সোমা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চোখের অশ্রুকণাকে আঁটকে রাখে। এত অল্পতেই অশ্রু বিসর্জন দিলে হবে? এখনও তো দেখার অনেক বাকি।

এরপর অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও আর কাউকে দেখা যায় না।

সোমা রুনুর চড়া কণ্ঠস্বর শুনে ভেতরে চলে যায়।

“ম্যাডাম আপনার চা তো ঠাণ্ডা অইতাছে। হেই কবে চা দিছি।”

” ওহ ভুলে গিয়েছি। তুই এককাজ কর নতুন করে আবার গরম গরম এক মগ চা বানিয়ে নিয়ে আয় চট করে। দেরি করলে কিন্তু মিস করবি। তোকে আজ একটা মজার দৃশ্য দেখাব।”

ঠিক দুই মিনিটেই রুনু চা হাতে নিয়ে ফিরে আসে। সোমা বুঝতে পারে রুনু নতুন করে চা বানায়নি, পুরনো চাই গরম করে নিয়ে এসেছে।

সোমা কিছু বলে না। কারো সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে তার ভালো লাগে না। বয়স হলে যা হয় আরকি। অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করে থাকতে হয়। অনেক কিছু শুনেও না শোনার ভান করে থাকতে হয়।

রুনু এসে পাশে দাঁড়ায়। উৎসুক দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকায়।

“কী দেখাইবেন কন?”

“কিছু না।”

“কইলেন যে!”

” কয় মিনিট লাগত নতুন করে চা বানাতে?”

“ম্যাডাম এখন নিয়ে আসি? ”

“লাগবে না। আমি এটাই খাব।”

এমন সময় মতি মিয়া বেরিয়ে যায় তার খুপরি ঘরের ভেতর থেকে। তার কাঁধে একটা গামছা।  মুখে প্রশান্তির হাসি। মতি মিয়ার পিছন পিছন বের হয় একটা বছরে দশেকের মেয়ে। পিঠে স্কুল ব্যাগ, গায়ে নতুন স্কুল ড্রেস। মতি মিয়ার স্ত্রী স্বামী, সন্তানকে আগলে রেখে বিড়বিড় করে কিছু একটা পড়ে দুজনের গায়ে ফুঁ দেয়।

“দেখলি মেয়েটার বয়স তোর থেকেও কম হবে। ভেবেছি তোকেও স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেব। তুই না স্কুলে পড়তি।”

“না ম্যাডাম আর পড়ুম না।”

“কেন?”

“পড়তে ভালো লাগে না। আর পড়লে ট্যাকা দিব কে?”

সোমা কিছু বলতে যাবে এমন সময় কিচিরমিচির করে জানালার গ্রিল দিয়ে উড়ে এসে চড়ুই পাখি দুটো তার পাশাপাশি বসে। সকালের সোনা রোদ গায়ে মাখে।একজন একজনের ঠোঁটে চুমু খায়। আবার কিচিরমিচির করে নিজেদের বাসায় কি যেন বলে।

“ম্যাডাম পাখিগুলানের পোলামাইয়া নাই?”

“থাকতে পারে।”

“কিন্তু দেখি না যে। আমরা আগে যে বাসায় থাকতাম   হেই বাসায়ও এই পাখিগুলানই আছিল। তাগোও পোলামাইয়া আছিল না।”

সবগুলো চড়ুই পাখি দেখতে একই রকম রুনু হয়তো সেটা বলতে পারবে না।

“আচ্ছা, তোর কি মনে হয় আমার ছেলে মেয়ে নেই?”

রুনু পিক করে হাসে। মনে হচ্ছে কথাটা ভীষণ লজ্জার।

“মায়ের কাছে হুনছি আছে। হ্যরা বিদাশ।”

“তাহলে!”

“ম্যডাম আমি যাই এখন।”

“আচ্ছা”

রুনু হেলেদুলে হাসতে হাসতে বারান্দায় থেকে ভিতরে চলে যায়।

এই বিলাশ বহুল অট্রালিকায় ড্রাইভার, দারোয়ান, মালি আর দুটো কাজের মেয়ে নিয়ে সোমার সংসার।

কী নেই তার! গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংক, ব্যালেন্স সব আছে। যাকে নিয়ে সংসার, যাদের নিয়ে সংসার হয় কেবল তারাই নেই।

মতি মিয়ার মতো একটা ছোট্ট খুপরি ঘরের সুখের সংসার সোমারও ছিল।

সে অনেক, অনেকদিন আগে। একটা রুম, একটা খাট, একটা সংসার। চারজন মানুষ গাদাগাদি করে একটা ছোট্ট খাটে ঘুমাতো। মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে পাশাপাশি বসে খেতো। একটা ডিম, এক প্লেট ভাত আর চারজন মানুষ। আহা কী তৃপ্তি!

প্রায় রাতে সোমা স্বামীর উপর রাগ করত, শুধু রাগ নয় রীতিমতো ঝগড়া করত। মশারির সাথে লেগে যখন বাচ্চাদের সারা হাত মশার কামড়ে চাকা চাকা হয়ে যেতো। ছোট্ট ছেলেটা যখন বিছানায় জায়গার অভাবে মধ্য রাতে মশারির সাথে ঝুলে থাকতো।

অপরাধীর মতো মুখ করে তখন সোমার স্বামী রাহাত বালিশ একটা হাতে নিয়ে দুই হাত প্রশস্ত মেঝেতে নেমে যেতো।

যে তার কষ্ট হলেও যেন স্ত্রী -সন্তান ঠিকমতো ঘুমাতে পারে। সোমার তখন মেজাজ আরও খারাপ হতো।

সোমা অপেক্ষা করতো গভীর রাতের। কখন তার স্বামী  স্ত্রীর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য তার কাছে আসবে। সোমা তখন ক্ষিপ্র বাহিনীর মতো ঝাপিয়ে পড়তো রাহাতের উপর। নিশ্বব্দে কথার বাণে অপারাগ স্বামীকে জর্জরিত করতো। যে পুরুষ একটা ঘর বিনিয়ে দিতে পারে না স্ত্রী, সন্তানকে, সে পুরুষের স্ত্রীর সান্নিধ্য পাওয়ার কোনো অধিকার নেই।

বাচ্চারা জেগে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় রাহাত কুঁকড়ে যেতো। তার উৎসাহে ভাটা পড়তো। যে অনুভূতি নিয়ে সে  স্ত্রীর কাছে যেতো সেই অনুভূতি প্রবন মনের মৃত্যু ঘটতো।

এর পর কয়েকদিন রাহাত সোমার উপর রেগে থাকতো। রাগ করলেও অন্য আট দশটা পুরুষের মতো  রাহাতের স্ত্রীর থেকে বিছানা আলাদা করার সুযোগ ছিল না।

একটা সময় সোমা স্বামীর অপারগতা বুঝতে পারতো। নিজ থেকে গিয়ে স্বামীর কাছে নিজেকে প্রকাশ করতো।

তারপর গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে যেতো মতি মিয়ার সংসারের মতো সোমার সংসারের সুখ, আনন্দ আর  ভালোবাসার জোয়ার বইতো তারা একসাথে চাপা কলের পানিতে গোসল করতো।

সোমার পুরো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে থাকতো একগুচ্ছ ভেজা চুল। রাহাত সে চুলের পানি হাত দিয়ে নিংড়ে ফেলে দিতে দিতে স্ত্রীর কপালে চুমু খেতো।

বহুবছর আগে স্মৃতির বন্ধ কপাটে ঢু মেরে সোমার চোখের মতো মনও আদ্র হয়ে উঠলো।

সোমা হাত বাড়িয়ে তার বব কাটিং চুলগুলো ছুঁয়ে দেয়।

তার শূণ্য কপাল, শূণ্য চুল কত কত বছর এখানে প্রিয়জনের কোনো স্পর্শ পড়েনি।

সোমা চঞ্চল হয়, চঞ্চল হয় তার ভালোভাসাহীন মরুময় মন। সে ছুটে গিয়ে মোবাইল এনে রাহাতকে ফোন দেয়।

তিনহাজার টাকা বেতনের কর্মচারি রাহাত এখন বড় বিজনেসম্যান। মাসের অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে কাটায়। দেশে থাকলে ব্যবসা, বাণিজ্য, মিটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাসায় ফিরে মধ্যরাতে। তারপর নিজের রুমে তার জগৎ তার ড্রিংকস, তার ল্যাপটপ তার বিদেশি বায়ার তাদের সাথে অনলাইন মিটিং।

একসময় রাত বেড়ে মধ্যরাত হয়, মধ্যরাত হয় ভোর। তাদের আর ভালোবাসাবাসি হয় না।

একসময় রাহাতের কিছুই ছিল না, স্ত্রীকে দেয়ার মতো সময় ছিল, ভালোবাসার মতো মন ছিল। এখন তার সব আছে শুধু স্ত্রীকে দেয়ার মতো সময় নেই। ভালোবাসার মতো মন নেই।

“তোমার না-কি আগামী শনিবারে দেশে আসার কথা?”

“কেন টাকা পয়সা কিছু লাগবে?”

সোমা দীর্ষশ্বাস গোপন করে বলে,

“না।”

“আচ্ছা, তাহলে ভালো থেকো। আমার আরও কয়টা দিন দেরি হতে পারে।”

সোমা আর কথা খুঁজে পায় না, অধরা অাকাশের তারাকে আর কি বলবে।

সোমা একই বসায়  বড় ছেলে অন্তুকে ফোন করে,

“কেমন আছো বাবা?”

“হেই মা ভালো না থেকে উপায় আছে বলো? কোথায় বাংলাদেশ আর কোথায় আমেরিকা! ময়লা, মশা, পচা গন্ধ আর লোডশেডিং ছাড়া আর কি আছে বাংলাদেশে?

সোমা আর বলার সাহস পায় না।

“বাবা দেশে কবে আসবে?”

“এককাজ করো বাবাকে নিয়ে তুমিও চলে আসো।”

সোমা মিনমিন করে,

“আচ্ছা।”

“ঠিক আছে মা, এখন বাইরে আছি। বাসায় ফিরে কল দেব।”

অন্তুকে সোমার কেমন যেন অচেনা লাগে।  এক টাকা দামের কমলা রঙের ললিপপ কিনে মা, ভাইয়ের সাথে শেয়ার করে খাওয়া অন্তু আর স্কলারশীপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়া অন্তু এক নয়।

সোমার অনুর জন্য মন খারাপ হয়। তারপরও অনুকে কল করতে গিয়েও আর করা হয় না। অনু স্বামী, সন্তান নিয়ে কানাডায় থাকে। অসময়ে কল করলে সে বিরক্ত হয়।

সোমা আবার ছুটে বারান্দায় যায়, মতি মিয়ার স্ত্রীকে দেখা যায়। সে ছুটাছুটি করে সব কাজ গুছিয়ে রাখছে। কাজ থেকে স্বামী ফিরলে, স্কুল থেকে কন্যা ফিরলে তাদেরকে সময় দিতে হবে।

সোমার হাতে অনন্ত সময়, তার ঘরে ফেরার তাড়া নেই। তার অপেক্ষায় কেউ নেই। সেও কারও অপেক্ষায় নেই।

ছোট গল্প

সময়ের ব্যবধান

কামরুন নাহার মিশু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here