মগজাস্ত্র (শেষ পর্ব )
ক্রাইম সিন থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটাও কথা বললেন না মিঃ নাইডু,এক মনে ছোট্ট ডাইরীটাতে কি সব লিখতে থাকলেন।ওনাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে নীলাদ্রি সেন ফিরে গেলেন থানায়।চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশানালের এই অনিমেষ চ্যাটার্জি ছিলেন শহরের একজন নামকরা বিজনেসম্যান,ওপর মহলেও ওনার প্রচুর চেনা জানা ছিল,মিঃ চ্যাটার্জির একমাত্র ছেলে থাকে জার্মানিতে,সে ওখানে পড়াশোনা করে,আর মিঃ অনিমেষ চ্যাটার্জির স্ত্রী মিসেস রমলা চ্যাটার্জি হলেন পেশায় একজন গাইনোকলোজিস্ট,নার্সিংহোম আর নিজের পেশেন্টদের নিয়েই উনি ব্যস্ত থাকেন সব সময়,মিঃ চ্যাটার্জির সঙ্গে ওনার সম্পর্কটা ছিল খুবই ফর্মাল,দুজনের কেউই কারোর ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করতেন না।
রমলা চ্যাটার্জি খুবই স্বাধীনচেতা মহিলা,ওনার সঙ্গে ওনার স্বামীর বয়সের অনেকটাই তফাৎ,বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মিঃ চ্যাটার্জির প্রতি মিসেস রমলা চ্যাটার্জির আকর্ষণ ক্রমশঃ কমতে থাকে,উনি নিজের মত জীবন কাটাতে বেশি পছন্দ করেন আর এই নিয়ে মিঃ চ্যাটার্জির মনে ক্ষোভ জন্মালেও উনি চুপ থাকেন সোশ্যাল স্টেটাসের কথা ভেবে।ওনাদের স্বামী স্ত্রীর মধ্যে থেকে যায় শুধুই একটা লোক দেখানো সম্পর্ক।
মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে এই সমস্ত খোঁজ খবর বের করেন মিঃ নাইডু,তারপর উনি থানায় গিয়ে খুনের দিনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ চেক করেন ভালো করে। ওইদিন দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের পর থেকেই মিঃ চ্যাটার্জির কেবিনে লাগানো 5 নাম্বার ক্যামেরাটির ছবি প্রথমে ব্লার হয়,তারপর কালো হয়ে যায়।সন্ধ্যা 7 টার পর অফিস খালি হয়ে যায়,শুধু একা থেকে যান মিঃ চ্যাটার্জি,আর ওনার বিজনেস পার্টনার মিঃ বাজপেয়ী।সেই সময় কেউ ঢোকেনি ওনার কেবিনে, মানে সিক্যুরিটি গার্ড কাউকেই আসতে দেখেনি এই অফিসে,আর প্রতি দিনই অফিস ছুটির পর ওনারা দুজনে বসে কিছু জরুরী ডিসকাশন সেরে নেন তারপর নিজেদের গাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরে যান কিন্তু সেইদিন অফিস ছুটির পরে বসের রুমে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে চিৎকার চেঁচামেচি করে লোকজনকে ডাকা শুরু করেন মিঃ বাজপেয়ী,তারপর উনিই পুলিশকে কল করেন।অন্য সিসি ক্যামেরার ফুটেজও তাই বলছে,সন্ধ্যা সাতটার পর সবাই চলে গিয়েছিল আর সন্ধ্যা সাতটা থেকে আটটার মধ্যেই হয়েছে এই খুনটা।
মিঃ নাইডু হোয়াইট বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যালেন্ডারে মার্ক করা ওই নাম্বার গুলো লিখে সেগুলোর মানে বের করার চেষ্টা করছিলেন,”ক্যালেন্ডারের প্রতি মাসেই 1 থেকে শুরু করে 30 ও 31 টা দিন থাকে,শুধু ফেব্রুয়ারি মাস 28 আর চার বছর অন্তর 29 দিনের হয়,কিন্তু এই নাম্বার গুলোর কি মানে হতে পারে?” 3,4,11,10,6,যদি অ্যালফাবেটিক্যালি দেখা যায় তাহলে 3=C,4=D,11=K,10=J, 6=F হয়,অর্থাৎ – CDKJF কিন্তু এটাকে উল্টে পাল্টে কোনো ভাবে সজিয়েই কোনো মানে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না অতএব এটা সঠিক চিন্তা ভাবনা নয়,অন্য ভাবে ভাবতে হবে।
আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে সেদিন মিঃ নাইডু গেলেন মিসেস চ্যাটার্জির সঙ্গে দেখা করতে,সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ উনি ফ্রি থাকবেন বলেছিলেন,তাই মিঃ নাইডু ৭ টা বাজার কিছুক্ষন আগেই পৌঁছে যান ওনার বিলাসবহুল বাংলোতে। বাড়ির কাজের লোক লক্ষণ কাকা বসার ঘরে মিঃ নাইডুকে অপেক্ষা করতে বলেন,কিছুক্ষণের মধ্যেই হালকা গোলাপী রঙের একটা গাউন পরে ওই ঘরে হাজির হন মিসেস রমলা চ্যাটার্জি,৪৫/৪৬ বছর মত বয়স,অপূর্ব সুন্দরী,কাঁধ পর্যন্ত লম্বা স্ট্রেট চুলগুলো একটা পনিটেলের আকারে বাঁধা,নিরাভরণ দুটি হাত,এটা অবশ্যই বৈধব্যের জন্য নয়,উনি একজন সার্জেন, সারাদিনে ওনাকে অনেকগুলো OT করতে হয়,তাই হাতে চুড়ি,আঙ্গুলে আংটি এগুলো থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক লাগতো।
ওনাকে দেখে মিঃ নাইডু দুইহাত জোড় করে নিজের পরিচয় দিলেন,অল্প হেসে মিসেস চ্যাটার্জিও ওনাকে নমস্কার জানিয়ে সামনের সোফায় বসলেন। “হ্যাঁ বলুন,কি জিজ্ঞাসা করতে চান?তবে আমি কিন্তু বেশি সময় দিতে পারবো না,আর আমার যা বলার ছিল সেসব পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছি,নতুন করে আর কিছুই বলার নেই,চটপট জিজ্ঞেস করুন যা জানতে চান,আমার আবার চেম্বারে যেতে হবে।”
“আমি সরাসরি প্রশ্নে আসছি,মিঃ চ্যাটার্জির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল সেসব প্রশ্ন করে আপনাকে বিব্রত করবো না,ওই সব প্রশ্নের উত্তর আমি আগে শুনে নিয়েছি।আমি আপনার কাছে জানতে চাইবো,আপনার স্বামীর কোনো শত্রু ছিল কী?বা অফিসে কারোর সঙ্গে ওনার কোনো মত বিরোধ বা ঝামেলা হয়েছিল কী?”
“দেখুন মিঃ নাইডু,আগেই আপনাকে বলেছি,অনিমেষের সঙ্গে আমার রিলেশন ছিল একেবারেই ফর্মাল,ওর বিজনেস বা পার্সোনাল লাইফে আমি কোনোদিন ইন্টারফেয়ার করতাম না আর সেম ভাবেই সেও আমার কাজ আর পার্সোনাল লাইফে কোনো ইন্টারেস্ট দেখাতো না,আমাদের মধ্যে প্রতিদিন কথাও হতো না আবার কাজের প্রেশার বেশি থাকলে কখনো হয়তো দিনের পর দিনও দেখা হতো না,আমাদের বেডরুম বহুদিন থেকেই আলাদা,কাজের জগৎ আলাদা, তাই টাইম শিডিউল ম্যাচ না করলে একই বাড়িতে বাস করেও আমাদের দেখা হতো না অনেক সময়,প্রাক্টিক্যালি অনিমেষ কেন খুন হল,সেই ব্যাপারে কোনো আইডিয়াই নেই আমার।আচ্ছা মিঃ নাইডু,এবার আমাকে উঠতে হবে,রেডি হয়ে নার্সিংহোমে যেতে হবে।”
নমস্কার করে উঠে পড়লেন মিসেস রমলা চ্যাটার্জি।ওখান থেকে বেরিয়ে নাইডু সোজা গেলেন থানায়,”সিভিল ড্রেসে আমার দুজন লোক লাগবে,একজন চ্যাটার্জির ম্যানশনের বাইরে থেকে নজরদারী করবে আর একজন ডঃ রমলা চ্যাটার্জির ওপর নজর রাখবে,ওই মহিলা আগাগোড়া মিথ্যা কথা বলছেন এটা আমার এত বছরের এক্সপিরিয়েন্স থেকে বুঝতে পেরেছি,কে খুন করেছে,কেন করেছে,সবটাই উনি জানেন কিন্তু সম্পর্ক ছিলনা,ইন্টারেস্ট ছিলনা,এসব কথা বলে ভুল পথে চালনা করতে চাইছেন পুলিশকে!”
মিঃ নাইডুর কথা মত সিভিল ড্রেসে দুজন পুলিশ কর্মী মোতায়েন করা হলো রমলা চ্যাটার্জির বাড়ির বাইরে একজন আর ওনার পেছনে একজন।চ্যাটার্জি ম্যানশনে একটি শোক সভার আয়োজন করা হয়েছিল,সেই শোক সভায় আত্মীয় পরিজন ছাড়াও মিঃ চ্যাটার্জির অফিসের লোকেরাও এসেছিল,তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেই আগত লোকেদের গতিবিধি আর আচার আচরণের ওপর দৃষ্টি রেখেছিল বাড়ির ওপর নজর রাখা পুলিশ কর্মীটি,
তাছাড়া বাড়ির গেটে খুব শক্তিশালী একটি হিডেন ক্যামেরাও লাগানো হয়েছিল,সেই ক্যামেরার ফুটেজে নজর ছিল মিঃ নাইডু আর পুলিশ কন্ট্রোল রুমের।
কদিন নজরদারী করার পর দেখা গেল,মিঃ চ্যাটার্জির বিজনেস পার্টনার মিঃ বাজপেয়ী রমলা ম্যাডামের সঙ্গে বেশ ঘন ঘনই দেখা করছেন,প্রতিবারই উনি যখন দেখা করতে আসছেন,ওনার হাতে থাকছে একটি ব্রিফকেস আর পিঠে ল্যাপটপের ব্যাগ।মিঃ নাইডুর নির্দেশে এবার ওই বিজনেস পার্টনারের আর মিসেস রমলা চ্যাটার্জির ফোনের কল লিস্ট চেক করা হল,নাইডু যা সন্দেহ করেছিলেন ঠিক সেটাই হলো,রমলা ম্যাডামের সঙ্গে বিজনেস পার্টনার মিঃ মনোজ বাজপেয়ীর বহু দিনের পরিচয় এবং ওনারা বেশ ভালোই কথাবার্তা বলেন ফোনে!
দুই পুলিশ কর্মীকে তাদের ডিউটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো,মিঃ নাইডু জানালেন ওদের আর দরকার নেই,কেসটা প্রায় সলভ করেই ফেলেছেন উনি, এবার শুধু প্রমাণ দরকার।চটপট ক্যালেন্ডারে মার্ক করা নাম্বারগুলো নিয়ে বসলেন উনি,ওই বিশেষ টেবিল ক্যালেন্ডারটি তার আগেই উনি চেয়ে এনে ছিলেন মিঃ নীলাদ্রি সেনের কাছ থেকে।
নাম্বারগুলো আরেকবার লিখলেন হোয়াইট বোর্ডে 3,4,11,10,6 কিছুক্ষন ওই নাম্বার গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকার পর একটা উজ্জ্বল হাসির রেখা ফুটে উঠলো ওনার মুখে,”ইয়েস,আই গট ইট” আনন্দে একপাক নেচে নিলেন বৃদ্ধ নাইডু!নীলাদ্রি সেনকে ফোন করে জানালেন,”আগামী পরশু একটা প্রেস মিট রাখুন,ওইদিন সবার সামনে এই খুনের রহস্যের যবনিকা পতন হবে,এখন ছোট্ট দু একটা কাজ বাকি আছে,সেই কাজগুলো আমি সেরে নিচ্ছি,আপনি প্রেস মিটের ব্যবস্থা করুন সেখানে মিঃ চ্যাটার্জির অফিসের স্টাফদের আর মিসেস রমলা চ্যাটার্জি কেও অবশ্যই ডাকবেন।”
অডিটোরিয়ামে ভর্তি প্রেসের লোকজন,স্টেজের ওপর বসে আছেন পুলিশ ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদস্ত ব্যক্তিরা আর ওখানে উপস্থিত আছেন মিসেস রমলা চ্যাটার্জি আর মৃত অবিনাশ চ্যাটার্জির অফিসের স্টাফরা।উঠে দাঁড়িয়ে বলা শুরু করলেন মিঃ নাইডু —– “চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশানালের মালিক মিঃ অবিনাশ চ্যাটার্জি খুন হন নিজের অফিসের কেবিনে,এই কথা টিভি ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে আপনারা সকলেই জানেন,খুবই সুনিপুণ ভাবে ঠান্ডা মাথায় কৌশলে ওনাকে খুন করা হয়েছে,যে ব্যক্তি এই খুন করেছেন তিনি মিঃ চ্যাটার্জির খুবই চেনা এবং বিশ্বস্ত মানুষ তাই প্রথমটায় মিঃ চ্যাটার্জি নিজেও ভাবতে পারেননি যে ওনাকে এমন অতর্কিতে খুন করে ফেলা হবে,কিন্তু শ্বাস রুদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার মুহূর্তে পেনস্ট্যান্ড থেকে একটি পেন তুলে নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে উনি সামনের টেবিল ক্যালেন্ডারের পাতায় কয়েকটি ডেটের ওপর গোল গোল মার্ক করে দেন,খুনি তখন ওনাকে খুন করতে ব্যস্ত ছিল তাই সে এই ব্যাপারটা লক্ষ্যই করেনি,কিন্তু অবসর সময়ে ডিটেকটিভ গল্প পড়তে ভালোবাসা এই বৃদ্ধ মানুষটি একটি ক্লু রেখে যান খুন হওয়ার মুহূর্তে!
উনি যে নাম্বারগুলি মার্ক করেছিলেন সেগুলো হলো –3,4,11,10,6 প্রথমে আমি ইংরেজী বর্নমালার 26 টা লেটার বসিয়ে নাম বা কোনো শব্দ খোঁজার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু আসল ব্যাপারটা সেটা ছিলনা তাই প্রথমে বারবার হোঁচট খাচ্ছিলাম,তারপর নিজের মত করে কিছু ইনভেস্টিগেশন করতেই একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল ওই নাম্বারের ধাঁধা!এখন আমি এই নাম্বারের ধাঁধা সমাধান করে এর থেকে একটা নাম বের করে দেখাবো আপনাদের,আর মৃতের দেওয়া এই ক্লুকেই আমরা তার মৃত্যু কালীন বয়ান বলে ধরবো।”
এই কথা বলে স্টেজে থাকা হোয়াইট বোর্ডে 3,4,11,10,6 এই নাম্বারগুলো লিখে ফেললেন মিঃ নাইডু, “দেখুন,প্রথমে আমি অ্যালফাবেট ভেবেছিলাম,কিন্তু সেটা ভুল ভাবনা ছিল,তারপর অন্য রকম ভাবে ভাবলাম,ক্যালেন্ডারে বারোটা মাস হয় আমরা যদি ওই নাম্বারগুলোকে একেকটা মাস হিসাবে ধরি তাহলেই কিন্তু একটা নাম বেরিয়ে আসছে অর্থাৎ — 3= March 4= April 11= November 10=October 6= June এবারে এর থেকে প্রথম লেটার গুলোকে আলাদা করে নিলেই উঠে আসছে একটা নাম! “MANOJ”এই মনোজ হল মৃত মিঃ চ্যাটার্জির বিজনেস পার্টনার মিঃ মনোজ বাজপেয়ী…!! “না…আ…আ…আমাকে খুব বিশ্রী ভাবে ফাঁসানো হচ্ছে!উদ্ভট গল্প সাজিয়ে এভাবে কাউকে খুনি সাব্যস্ত করা যায়না…!!” চিৎকার করে উঠলেন বিজনেস পার্টনার মিঃ মনোজ।
” চেঁচাবেন না মিঃ বাজপেয়ী,আপনিই যে খুনি তার উপযুক্ত প্রমাণ আমাদের কাছে আছে,আমরা সবকিছু যোগাড় করে নিয়েছি,এবার আপনি নিজেই এসে বলবেন,নাকি আমিই বলে দেবো পুরো ব্যাপারটা?”
চিৎকার করে ওঠেন মিঃ বাজপেয়ী,”হ্যাঁ হ্যাঁ,আমিই মেরেছি চ্যাটার্জিকে,কিন্তু মেরেছি এই মহিলার কথায়,এই রমলা চ্যাটার্জি একজন বিষধর নাগিন,প্রথমে নিজের প্রেমের জালে আমাকে ফাঁসিয়ে তারপর আমাকে বাধ্য করে ওর স্বামী কে খুন করতে,সমস্ত পরিকল্পনা ওরই করা!”
মনোজের কথা শুনে হিসহিস করে উঠে রমলা,”মনোজ,ভুলে যেওনা অবিনাশ মরার আগে তোমার নাম লিখে গেছে,তুমি কিন্তু ফালতু আমার নামে ব্লেম দিচ্ছ!”
দুজন লেডি কনস্টেবল ততক্ষণে রমলা চ্যাটার্জি কে দুপাশ থেকে চেপে ধরে বসিয়ে দেয়,”আপনি চুপ করে বসুন ম্যাডাম,পুলিশকে নিজের কাজ করতে দিন।” নাইডু বলা শুরু করেন,”অবিনাশ চ্যাটার্জির বাবাও ছিলেন একজন বড়ো মাপের ব্যবসায়ী,ওনারা ছিলেন বনেদী বড়লোক,সেই তুলনায় রমলা দেবীর পারিবারিক অবস্থা ছিল অনেকটাই খারাপ,মিঃ চ্যাটার্জির সঙ্গে বয়সের অনেক ফারাক ছিল রমলা দেবীর,কিন্তু বিপত্নীক অবিনাশের খুব পছন্দ হয়ে ছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে রমলাকে,ছেলের পছন্দ জানতে পেরে রমলার সঙ্গে ছেলের বিয়ে ঠিক করে ফেলেন অবিনাশের বাবা,বিনিময়ে মেধাবী রমলা কে বিদেশে পাঠিয়ে ডাক্তারী পড়াবার প্রস্তাব দেন,এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান রমলা দেবী ও ওনার বাবা,বিয়েটা হয়ে যায় ওদের,বিয়ের তিনমাস বাদে রমলা বিদেশে চলে যান পড়তে আর অনিমেষও মাঝে মধ্যে কিছুদিন করে কাটিয়ে আসেন গিয়ে বউয়ের সঙ্গে,তারপর আবার ফিরে এসে নিজের কাজে মন দেন, এই ভাবেই কাটছিল রমলা দেবীর ডাক্তারী পড়ার দিনগুলো,তারপর ডাক্তারী পাস করে উনি দেশে ফিরে আসেন।
রমলা দেশে ফেরার আগেই মিঃ চ্যাটার্জি এই নার্সিং হোমটি কিনে অত্যাধুনিক ভাবে সাজিয়ে রেখেছিলেন,বউ ডাক্তার হয়ে ফিরতেই শুরু হয় নার্সিং হোমের কাজ।এর মধ্যেই রমলা দেবীর একটি ছেলে হয়,খুব ছোট থেকেই সে বিদেশে থেকেই পড়াশোনা করে,বাবার সঙ্গে তার খুব একটা অ্যাটাচমেন্ট তৈরীই হয়না, সেই সময় অবিনাশ চ্যাটার্জি হঠাৎ করেই একদিন অসুস্থ হয়ে পড়েন,ওনার হার্টে ব্লকেজ দেখা দেয়,ডাক্তাররা ওনাকে বিশ্রাম নিতে বলেন,হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর 70:30 পার্টনারশিপে ব্যবসা করা শুরু করেন ওনার নতুন পার্টনার মনোজ বাজপেয়ীর সঙ্গে,মনোজের বয়স অল্প,আর ওর সুঠাম চেহারা দেখে ওর প্রেমে পড়েন মিসেস রমলা চ্যাটার্জি,ক্রমে সেই প্রেম গভীর হয় আর একদিন অবিনাশ সেটা জানতে পেরে যান,সেই থেকেই ওদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে,অবিনাশ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিলেন মনোজ কে তাড়িয়ে দেওয়ার কিন্তু পারেননি,দুজনের মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই চলতে থাকে কিন্তু অসুস্থ থাকায় কোম্পানির বাইরে ঘুরে করার কাজগুলির দায়িত্ব মনোজের হাতে দিতেই হয়,আর মনোজ একটু একটু করে গ্রাস করতে থাকে সবকিছু।
রমলার সঙ্গে যুক্তি করে গোপনে মনোজ পেপার্স রেডি করায়,পুরো ব্যবসাটা নিজের নামে করার জন্য,আর পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক ওইদিন লাঞ্চ আওয়ারে অফিসের সিসি ক্যামেরায় টেপ লাগিয়ে পেপার্স গুলো সাইন করার জন্য জোর করতে থাকে মিঃ চ্যাটার্জির কাছে,উনি কিছুতেই রাজি হতে চাননা,মনোজ তখন ওনার বউয়ের সঙ্গে মনোজের অন্তরঙ্গ অবস্থার ছবি দেখিয়ে সেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে জোর করে পেপার্সে ওনাকে সই করায় আর অতর্কিতে পেছন থেকে ওনার গলায় নাইলনের দড়ি পরিয়ে ফাঁস দিতে থাকে,নিরুপায় অবিনাশ ওনার হাতে ধরা কলম দিয়ে পাশে রাখা ডেট ক্যালেন্ডারের ওপর ওই সাংকেতিক কয়টা সংখ্যা মার্ক করে দেন, কিন্তু মনোজ সেটা লক্ষ্য করেনা!
অবিনাশের শ্বাসরুদ্ধ করে দেওয়ার পর মনোজ আবার নিজের কেবিনে ঢুকে যায় আর কায়দা করে অবিনাশের কেবিনে আর কাউকে ঢুকতে দেয়না, অফিস ছুটির পর সকলেই বেরিয়ে পড়ে অফিস থেকে আর মনোজ কিছুই না জানার মত বসের কেবিনে ঢুকে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়।পুরো কর্ম কাণ্ডটি সে হাতে গ্লাভস পরে করেছিল তাই কোথাও ওর কোনো হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি কিন্তু প্রথম ভুল সে করেছিল ওই রুমের সিসি ক্যামেরার টেপটা খুলতে ভুলে গিয়েছিল আর অবিনাশ যে মারা যাওয়ার আগে ক্যালেন্ডারে কটা ডেট গোল মার্ক করে ফেলেছেন সেটা লক্ষ্যই করেনি!এই দুটো ভুল করে ফেলার জন্য আজ সেই যে খুনি এটা প্রমাণিত হলো।তবে এই অভিনব কেসটি সলভ করতে পেরে আমারও খুব ভালো লাগছে,অবিনাশ যদি বুদ্ধি করে ওই নাম্বারগুলো মার্ক না করে যেতেন তাহলে এতটা সহজে আমিও খুনিকে ধরতে পারতাম না।”
পুরো হলে পিন পতন নিস্তব্ধতা ছিল এতক্ষণ,এবারে হাত তালির আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠলো পুরো হল।মোটে কয়েকটা দিনের মধ্যেই মিঃ নাইডু সমস্ত ইনফর্মেশান যোগাড় করে এই জটিল খুনের রহস্যটি একেবারে জলের মতো সহজে সলভ করে ফেললেন।পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে নিজের ফিসের টাকার পরিমাণটা জানিয়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে গটগট করে হল থেকে বীরদর্পে বাইরে বেরিয়ে গেলেন ৬৫ বছরের বৃদ্ধ মিঃ রামাইয়া নাইডু,ওনার মুখটা তখন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার আনন্দে জ্বলজ্বল করছিল।
সমাপ্ত
স্নিগ্ধা চক্রবর্তী (কলকাতা , ভারত )
অনেক ধন্যবাদ জানাই,আমার গল্পটিকে স্থান
দেওয়ার জন্য… 🙏🙏
আমার এই গল্পের পাঠক/পাঠিকাদের কাছে
অনুরোধ,এই গল্পটি আপনাদের কেমন লাগলো সেটা কমেন্ট করে জানাবেন প্লিজ…
আপনাদের সহযোগিতা পেলে লেখার উৎসাহ
পাবো… 🙏🙏