ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় লাবন্যর সাথে প্রতিদিন সকালে সিড়িতে দেখা হয়ে যায় মিহিরের সাথে। লাবন্যপ্রথম ক্লাসটা ধরার জন্য খুব তাড়াহুড়ো করে নামতে থাকে আর ঠিক সেই মুহূর্তে মিহির মর্নিং ওয়াক শেষ করে বাসায় ফিরে।লাবন্য কিছুটা সময়ের জন্য থমকে যায়। ও ভুলে যায় ওর ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। স্টাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মিহিরের আগমন পথের দিকে তাকিয়ে। ঘর্মাক্ত শরীরের মিহিরকে দেখে ও কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারেনা। মিহির দেখতে এতোটাই আকর্ষণীয় আর পেটানো শরীর যে শুধু লাবন্য কেন যে কোন মেয়ের স্বপ্ন পুরুষ এই মিহির।
সকালের এই সময়টা লাবন্যর খুব প্রিয়। মিহির যখন ওর চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি ছুড়ে দেয়।স্বল্প সময়ের জন্য ও ভুলে যায়, ও দেখতে মোটেও সুন্দরী নয়। ওর গায়ের রং কালো। বন্ধু মহলে সবাই ওকে আড়ালে মা কালি বলে ডাকে।
পাঁচ ফিট চার ইঞ্চি উচ্চতার লাবন্যর আকর্ষণীয় ফিগার আর দীঘল কালো লম্বা চুল দেখে অনেক পুরুষ পাগল হয়ে যায় ঠিকই। কিন্তু সেটা পেছন থেকে দেখে। সামনে এসে গাঁয়ের রং দেখেই তারা পিছিয়ে যায়। গায়ের রং নিয়ে লাবন্যর মনে এক ধরনের চাপা কষ্ট সবসময় কুড়ে কুড়ে খায়। মনটা ছোট হয়ে থাকে।
কিন্তু শুধু এই একটা সময় ও ভুলে যায় ও দেখতে সুন্দর না। মিহিরের এই একটুখানি হাসি ওকে যেন নিয়ে যায় অন্য রকম এক ভালো লাগার জগতে।
কিছুটা সময় পর সে আবিষ্কার করে মিহির নেই। ও একাই দাঁড়িয়ে আছে আর আকাশ কুসুম কল্পনা করছে।
লাবন্য দেখতে যেমনি হোক পড়াশোনায় সে টপার।
মা মরা মেয়েটা বাবার আদরেই বড়ো হয়েছে। ক্লাস টেন পর্যন্ত তার রেজাল্ট মোটামুটি ধরনের। টেস্ট পরীক্ষার পর হঠাৎ করে তার পড়াশোনার ধরন চেন্জ হয়ে গেল। দিনরাত মুখের সামনে বই ধরে বসে আছে। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দিনরাত পড়তে দেখে মকবুল হোসেন রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন মা গো এতো পড়ার দরকার নাই। তুমি মোটামুটি ধরনের ভালো রেজাল্ট করলেই চলবে। আমার যা কিছু আছে সব তো তোমার জন্য।
লাবন্য খাবার মুখে নিয়ে হাসতে হাসতে বাবাকে তখন বলে আমাদের কি আছে বাবা? নিজের একটা বাড়ি ও নেই। তুমি ভালো একটা জব করো সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমরা থাকি ভাড়া বাসায়। কোন রকমে বাপ মেয়ের দিন কেটে যাচ্ছে ভাড়া বাসায়।
মকবুল হোসেন মেয়ের কথা শুনে শেষ লোকমা মুখে তুলে দিয়ে নরম সুরে বলে তুই কবে এত বড় হয়ে গেলি মা? এতো কিছু বুঝিস তুই!
মাগো আমাদের দুজনের জন্য এরচেয়ে বেশি তো দরকার নেই রে। আমি তোমার নামে ফিক্সড ডিপোজিট করেছি। সেখানে ভালো টাকা জমা হচ্ছে। তোমার নামে সাভারে একটা জায়গা কিনছি গো মা। খুব শীঘ্রই আমরাও বাড়ির মালিক হব।
লবন্য বাবার গলা জড়িয়ে ধরে স্মিত হেসে বললো আমার বাড়ি গাড়ি চাই না বাবা। আমি শুধু চাই তুমি সবসময় সুস্থ থাকো। এভাবে আমার পাশে থাকো।
যেদিন লাবন্যর রেজাল্ট হলো সেদিন সাংবাদিক দিয়ে ওদের এই দুই রুমের ভাড়া বাসাটা ভরে গিয়েছিল। সারা দেশের মধ্যে ছেলে মেয়ের মধ্যে লাবন্য হয়েছিল তৃতীয়। সেদিন লাবন্যর সাথে মকবুল হোসেনের ছবিও পেপারে ছাপা হয়েছিল।
লাবন্যর বন্ধু বান্ধব কম। তাই সে পড়াশোনা নিয়েই বেশীরভাগ সময় কাটায়। ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তির পর ওরা কলাবাগানের এই বাসাটায় উঠেছে।
চার তলার ওপরে দুই বেডের বাসাটা লাবন্যর খুব পছন্দ হয়েছে। পুরো ছাদটাই ওরা ব্যাবহার করতে পারে। বিশেষ করে রাতে যখন ইচ্ছে তখন লাবন্য ছাদে থাকতে পারে।
রাতের আকাশ লাবন্যর খুব বেশি প্রিয়। আরো বেশি প্রিয় জোৎস্না রাত, ঝুম বৃষ্টি ।
বৃষ্টি হলেই ও ছাদে চলে যায় বৃষ্টিতে ভিজতে। আজকে ভার্সিটি থেকে ফেরার পথেই শুরু হলো বৃষ্টি। বৃষ্টির বেগ এতোটাই বেশি যে, মামার দেওয়া পলিতেও ওর গা বৃষ্টির ছাঁট থেকে বাঁচতে পারছে না।
ও বাসায় এসেই ব্যাগটা কোন রকমে রুমে রেখে ছাদে চলে এলো ইচ্ছে মতো ভিজবে জন্য। ও জানে এই সময় ছাদে কেউ থাকে না। ওড়নটা একপাশের কাঁধের ওপর থেকে আরেক পাশের মাজায় নিয়ে বেঁধে ও শুরু করলো বৃষ্টির তালে তালে নৃত্য।
আনমনে নেচে চলেছে লাবন্য। কখনো পা দিয়ে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। নিজের ছেলে মানুষিতে নীজেই হেসে গড়িয়ে পড়ছে। ও ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারেনি ওর এই ছেলে মানুষি নাচ কেউ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে।
মিহির পা টিপে টিপে লাবন্যর কাছাকাছি এসে বললো, এই মেয়ে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে নাচছো, তোমার ঠান্ডা লাগবে না!
লাবন্য প্রথমে চমকে গেলেও নিজেকে ধাতস্থ করতে খুব বেশি সময় লাগলো না। স্মিত হেসে বললো সমস্যা নেই আমার অভ্যাস আছে। তবে আপনি ছাদে আছেন জানলে আজ ভিজতাম না। লাবন্য ঘুরে চলে যেতে নিলে ওর একটা হাতে টান পড়লো। ও ছিটকে গিয়ে পড়লো মিহিরের বুকে। মিহির শক্ত করে লাবন্য কে জড়িয়ে নিলো নিজের বুকে।
লাবন্য কাঁপছে। ঠকঠক করে কাঁপছে। ও বুঝতে পারছে না এটা কি বৃষ্টিতে ভিজে ঠান্ডার জন্য কাঁপছে, নাকি ওর স্বপ্ন পুরুষ ওর এতো কাছাকাছি সেই ভালো লাগার কাঁপুনি!
মিহির লাবন্যর চিবুক ধরে মুখটা তুলে ফিসফিস করে বললো তুমি এতো বেশি মিষ্টি কেন লাবন্য?
লাবন্য মুখটা নামিয়ে নিল লজ্জায়। আজ পর্যন্ত কোন ছেলে ওকে সুন্দর বলেনি। আর তাছাড়া ও খুবই ভালো করে জানে মিহির দেশের বাইরে পড়াশোনা করে। ছুটিতে এসেছে। আবার ফিরে যাবে খুব শীঘ্রই।
লাবন্য বুঝতে পারছে এগুলো হয়তো ওকে খুশি করার জন্যই বলা। তারপরও কেন যেন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে মিহিরকে।
তুমি ভয় পেয়ো না লাবন্য। আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না। তোমার আপত্তি না থাকলে শুধু একটা চুমু খেতে চাই।
লাবন্য কে চুপচাপ দেখে মিহির ধরেই নিল নিরবতা সম্মতির লক্ষণ। ও টুপ করে লাবন্যর নরম ঠোঁট দুটো নিজের দখলে নিয়ে নিল।
লাবন্যর কাছে সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। এমন স্নিগ্ধ চুমু! ওর জীবনে প্রথম কোন পুরুষ মানুষের এতো কাছাকাছি আসা। অন্য রকম এক শিহরণ ছড়িয়ে পরছে পুরো শরীর জুড়ে। বৃষ্টি থেমে গেছে। আকাশ লালচে রং ধারণ করে সূর্য ডুবতে চলছে। ঠান্ডা বাতাসের বেগ বাড়ছে। লাবন্য নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, এখানে আপনার আর থাকাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। বাসায় যান মিহির ভাইয়া।
সে রাতে লাবন্যর চোখে এক ফোঁটা ঘুম এলো না। মিহিরের ভাবনা ওকে আচ্ছন্ন করে রাখলো সারা রাত। মিহিরের স্পর্শ গুলো মনে করে শিহরিত হলো বারবার।
হঠাৎ করে বৃষ্টিতে ভিজে সে রাতে মিহিরের শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এলো। তিনদিন সে জ্বরে প্রায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলো। ওর কাছে প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল লাবন্য যদি একবার এসে ওর কপালে নরম হাতটা রাখত, তবে সব অসুখ ভালো হয়ে যেতো। মনে মনে খুব করে চাইছিল লাবন্য একবার আসুক ওকে দেখতে। ওর পাশে বসুক। পরম যত্নে ভালোবেসে ওর বুকে জড়িয়ে নিক।
এদিকে লাবন্য দিনরাত স্বয়নে স্বপনে মিহিরকে ভাবলেও, মিহিরদের বাসায় গিয়ে একটু উঁকি দিয়ে খোঁজ নেওয়ার মতো সাহস ওর হলো না। যেহেতু মিহিররা দুই ভাই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ও কখনো বাড়ি আলার বাসায় যায় না। তবে ও বাড়ির কাজের মেয়েটার কাছে শুনেছে মিহিরের খুব জ্বর।
মনে মনে সে নিজেকেই বারবার দায়ী করেছে মিহিরের অসুস্থতার জন্য। ওর কাছে মনে হচ্ছে সেদিন যদি ও ছাদে না যেতো, তবে হয়তো মিহির ভাইয়া এতো দীর্ঘ সময় ছাদে থাকতো না। আর এমন অসুস্থ ও হতো না।মিহিরের মা ছেলের টেনশনে নাওয়া খাওয়া ভুলে দিনরাত এক করে সেবা করছেন। দুই দিন পর ছেলের ফ্লাইট। আর এ সময়ে এমন অসুস্থতা তাকে অনেক বেশি চিন্তিত করে তুললো।
মায়ের ভালোবাসা আর সেবায় তিন দিনের দিন মিহির উঠে দাঁড়ালো। শরীর টাও আজ বেশ ঝরঝরে। জ্বর নেই। একটু দূর্বলতা রয়ে গেছে।দূর্বল শরীর নিয়েই সন্ধ্যায় মিহির ছাদে আসলো। পরের দিন ও চলে যাবে। আজকে দেখা না করলে লাবন্যর সাথে দেখা করার আর সুযোগ মিলবে না।
ও ছাদে এসে চুপচাপ আকাশ দেখছিল।লাবন্য এক মগ চা নিয়ে মাত্রই পড়ার টেবিলে বসেছে। জানালা দিয়ে মিহিরকে দেখা মাত্র ছুটে এসে মিহিরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।
অনেক কথা জমে আছে বুকে, কিন্তু মিহিরকে কাছে পেয়ে ওর মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না।মিহির স্মিত হেসে চিবুক ধরে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, এই পাগলি এভাবে কাঁদছো কেন?
লাবন্য হেঁচকি তুলতে তুলতে বললো, আমার জন্য আপনার এই অবস্থা। আমি নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবোনা।
শুধু শুধু নিজের কাঁধে দোষ নিচ্ছ কেন লাবন্য? সেদিন আমি এমনিতেই ছাদে এসেছিলাম কিছু ভালো লাগছিল না জন্য। এরমধ্যে শুরু হলো বৃষ্টি। অনেক দিন বৃষ্টিতে ভিজি না। খুব ইচ্ছে হলো ভিজি।ঠিক যেই মুহুর্তে ভাবলাম নেমে যাব, তখন আমার সামনে উপস্থিত হলো এক মিষ্টি পরী। পরীর নাচ আমাকে এতোটাই মুগ্ধ করলো, যে আমি আটকা পরে গেলাম অন্য রকম এক ভালো লাগায়।
লাবন্য লজ্জায় লাল হয়ে বললো, যান আপনি শুধু শুধু বাড়িয়ে বলেন। ছাড়ুন আমাকে। কেউ দেখে ফেললে খারাপ ভাববে।
মিহির শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো, বারে আমি বুঝি তোমাকে ধরে রেখেছি?নাকি তুমি এসে আমাকে এভাবে আদর করে জড়িয়ে ধরলা।
লাবন্য লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না। সত্যিই তো, সে এসে কিভাবে পারলো এমন করে জড়িয়ে ধরতে! এতোটা নিলজ্জ না হলেও বোধহয় চলতো।
লাবন্যর লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া চেহারা দেখে মিহির আরেকটু অগ্রাসী হয়ে উঠলো। সে আবারো লাবন্যর ঠোঁট নিজের ঠোঁটের মধ্যে পুরে নিল।
তারপর ছেড়ে দিয়ে বললো, লাবন্য কাল আমি চলে যাচ্ছি। একটা বছর আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না? এক বছর পর আমি তোমার কাছে ফিরে আসব।
লাবন্য মাথা কাত করে সম্মতি জানালো সে অপেক্ষা করবে।
তোমার ফোন নাম্বার আমাকে লিখে দাও। আমি গিয়ে তোমাকে ফোন করব মাঝে মধ্যে।
লাবন্য দিশেহারা বোধ করছে। ওর তো কোন ফোন নেই। ওর বাবা অপ্রয়োজনীয় কোন কিছু ওকে কিনে দেয় না। ও নিজেও কখনো ফোন জিনিসটাকে দরকারি মনে করেনি। এখন ওর কান্না করতে ইচ্ছে করছে আবারো।
লাবন্য কে দিশেহারা বোধ করতে দেখে মিহির হেসে ফেললো। বুঝেছি তোমার ফোন নেই এই তো। আচ্ছা ঠিক আছে এই কাগজটা রাখো। এখানে আমার নাম্বার আছে। তুমি বাইরে থেকে ফোন দিও। যদিও যাওয়ার পর আমার রুম চেন্জ হবে। তোমার নাম্বার আমার কাছে থাকলে বেশি সুবিধা হতো।
এখন আমি যাই কেমন। দেরি দেখলে মা আবার খুঁজতে ছাদে চলে আসবে।
সেই ছিল লাবন্যর সাথে মিহিরের শেষ কথা। মিহির চলে যাওয়ার পর লাবন্য প্রথম কিছু দিন ভালোই ছিল। মিহিরের স্পর্শ গুলো ওকে অনেক বেশি প্রেমময়ী করে তুলতো।
ওর হাতে টাকা আসলেই ও মিহিরের নাম্বারে ফোন করতো ফোনের দোকান থেকে। কিন্তু কখনও মিহিরকে সে নাম্বারে পাওয়া যেতো না। হয়তো সময়ের ব্যাবধানে ওদের টাইম মিলত না। হয়তো তখন মিহির ক্লাসে, নয়তো ঘুমে। নয়তো নাম্ববারটাই চেঞ্জ হয়েছে।
ছয় মাস পর থেকে লাবন্যর অবস্থা খারাপ হতে শুরু করলো। ও নাওয়া খাওয়া ভুলে রাত জেগে ছাদে অপেক্ষা করতো মিহিরের জন্য। একটা সময় পড়াশোনা, ক্লাস করা সব ওর জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসলো।
মকবুল হোসেন মেয়ের অবস্থা দেখে ভেঙে পড়লেন। তিনিও ঠিক মতো অফিস যেতে পারেন না মেয়ের এই অবস্থা দেখে। জোর করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেও লাবন্য মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। সে কোন সমস্যার কথা বলতে চায় না।ওষুধ খায় না। ওর এখন সবচেয়ে প্রিয় কাজ রাতের আকাশ দেখা।
যতোই দিন যাচ্ছে লাবন্যর স্বাস্থ্যের ততোই অবনতি হচ্ছে। মকবুল হোসেন মেয়ের এই দুরবস্থা সহ্য করতে পারেন না। লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের পানি ফেলেন। তিনি জোর করে মুখে খাবার তুলে দিলে দুই এক গাল নিয়েই আর খেতে চায় না।
মাঝ রাতে মকবুল হোসেন দেখলেন রুমে মেয়ে নেই। ছাদে হাঁটাহাঁটি করছে। তিনি পরম মমতায় পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন মারে তোর সমস্যা কোথায়? বাবাকে বলে মনটা হালকা কর।
লাবন্য চোখের পানি আটকাতে না পেরে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বলতে লাগলো বাবা ও বাবা, তুমি আমার মিহির কে আমার কাছে এনে দিতে পারবে? তুমি না সবসময় বলো আমার মা চাইলে আকাশের চাঁদ টাও আমি এনে দিতে পারি।
বাবা ও বাবা তুমি শুধু মিহিরকে আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। আমি আর কিছু চাই না।
মকবুল হোসেন ও মেয়ের সাথে কাঁদছেন। তিনি মেয়ের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন, মারে তুই কোন মিহিরের কথা বলছিস? বাড়ি আলার ছেলে মিহির?
হ্যা বাবা। ও আমাকে কথা দিয়েছিল এক বছর পর আমার কাছে ফিরে আসবে। গত মাসে এক বছর হয়ে গেল, মিহির তো এলো না বাবা!
পোড়ামুখি আর মানুষ পেলি না। আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিস। আচ্ছা ঠিক আছে কাল সকালে আমি কথা বলবো মিহিরের বাবার সাথে। এখন চল ঘুমাবি।
এদিকে মিহিরের বাবা ছেলে কে ফোন করে কঠিন ভাবে বলে দিয়েছে সে যেন এই মুহূর্তে দেশে আসার চিন্তা বাদ দেয়।
মিহির বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করেছে কেন বাবা? আমার তো টিকিট কাটা হয়ে গেছে। এখানে সব কিছু গোছানো শেষ।
গোছানো শেষ হলেও তুমি আসবে না। আমি চিন্তাই করতে পারি না যে, মকবুল সাহেবের এতো দুঃসাহস কোথা থেকে আসে!
কোন মকবুল সাহেবের কথা বলছো? কি হয়েছে? ঘটনা খুলে না বললে বুঝব কিভাবে?
আর বলিস না। ছাদে যে বাপ বেটিতে ভাড়া উঠছে, সেই মেয়ের বাবা জরুরী তলব দিয়ে তোকে দেশে ফিরিয়ে আনতে বলে। তার মেয়ে নাকি তোর জন্য মরে যাচ্ছে! কতো বড় সাহস হলে আমার সোনার টুকরা ছেলের জন্য ঐ কালো মেয়ে গচিয়ে দিতে চায়! আগে তো তাও একটু ভালো লাগতো। এখন শুকায় চিমছে হয়ে গেছে। মেয়ের চেহারার দিকে তাকানো যায় না। আমি বলেছি আগামী মাসে বাসা খালি করে দিতে। ওরা চলে যাওয়ার পর তুমি আসবে।
সেটা তো সম্ভব নয় বাবা। প্রথমত আমার টিকিট কাটা হয়েছে। আগামী সতেরো তারিখ আমি দেশে আসছি।
আর দ্বিতীয়ত আমি লাবন্য কে ভালোবাসি। আমি চলে আসার পর পরই আমার ফোন নাম্বার চেঞ্জ হয়, রুম ও চেঞ্জ হয়। যার জন্য আমি লাবন্যর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারিনি।
আমার জন্য মেয়েটা অসুস্থ হয়ে গেছে আর তুমি কিনা ওদের বাসা ছেড়ে দিতে বলছো! আশ্চর্য!
মকবুল হোসেন অফিস থেকে ফিরে দেখেন, লাবন্য এই ভর সন্ধ্যায় ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি পাশে এসে নরম সুরে বললেন, তোর শরীর এতো খারাপ নিয়ে ভর সন্ধ্যায় ছাদে কি করছিস মা?
আমার খুব অস্থির লাগছে বাবা।
আর তখনি সিড়ি দিয়ে কারো উঠে আসার পায়ের শব্দ হল। এই শব্দ লাবন্যর পরিচিত শব্দ। মিহির যখনি ছাদে আসে এই পায়ের শব্দটা শুনে লাবন্য বুঝে ফেলে মিহির আসছে।
লাবন্যর শরীর ঝিম ঝিম করছে। পেছন ফিরে যে দেখবে সেই শক্তিও তার নেই। মাথার মধ্যে সবকিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আবার ভয় ও লাগছে। যদি পেছন ফিরে দেখে মিহির না, অন্য কেউ।
মিহির কাছাকাছি এসে আবেগীয় কন্ঠে ডেকে উঠলো লাবন্য আমি চলে এসেছি। একবারে তোমার কাছে ফিরে এসেছি। এবার দেখো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এতো রোগা লাগছে কেন?
লাবন্য জবাব দিতে পারল না, ওর মাথা ঘুরে উঠল। সে হাত বাড়িয়ে মিহিরকে ধরতে চেষ্টা করল। ধরতে পারল না।
মিহির ছুটে এসে ধরে ফেলার আগেই ফ্লোরে পড়ে গেল। এবং ঠিক দুই মিনিটের মাথায় লাবন্য মারা গেল।
মিহির মুর্তির মতো বসে আছে ওদের ড্রয়িং রুমে। মাঝে মধ্যে ফোঁপানির মতো হচ্ছে। তবে চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে না।
মিহিরের মা চা নিয়ে এসে বললো মিহির চা খাবি?
হুম।
চায়ের কাপ দেওয়া মাত্র মিহির উঠে দাঁড়ালো। চা খাব না মা।
কি আশ্চর্য এই মাত্র বললি খাবি, আবার বলছিস খাব না! কি হয়েছে তোর?
মা লাবন্য মেয়েটা আমাকে খুব বেশি ভালোবেসেছিল। সেই ভালোবাসার মূল্য ওকে জীবন দিয়ে দিতে হবে আমি তা বুঝতে পারিনি মা।
হ্যা তোর বাবার কাছে শুনেছি। তোর বাবা অবশ্য রাজি না। তবে আমি তোর পাশে আছি। কথা গুলো বলতে বলতে মিহিরের মা অবাক হয়ে দেখলো, মিহিরের চোখ দিয়ে টপটপ করে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে।
তিনি তার ছেলে কে খুব শক্ত ধাচের বলেই জানেন। কখনো এক ফোঁটা পানি ফেলতে দেখেননি বড়ো হবার পর। তিনি ব্যাথিত সুরে জানতে চাইলেন, কি হয়েছে মিহির?
মা লাবন্য সন্ধ্যায় মারা গেছে।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই মিহিরকে জড়িয়ে ধরলেন। চিরন্তন মমতাময়ী নারী তার সুবিশাল বাহু প্রসারিত করলেন পরম মমতায়। মিহির কাঁপছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মমতাময়ী মা ছেলের পিঠে গভীর মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
খুব বড়ো রকম কষ্ট পেলে শব্দ করে মানুষ কাঁদে না। বড় ধরনের শারীরিক কষ্টের সময় মানুষ এরকম ফোঁপানির শব্দ করে। প্রিয় মানুষের মৃত্যুর কষ্ট শারীরিক কোন কষ্ট নয়, এই কষ্ট মাথার ভেতরে হয়।
রোকেয়া পপি