কনা এক ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখলো।
ব্যাচ ভিত্তিক এক অনুষ্ঠানে হাজার হাজার বন্ধুদের মাঝে ও নাচছে গানের তালে তালে। ওর শরীরে কোন পোশাক নেই। খুব স্বাভাবিক ভাবেই একটু অস্বস্তি বোধ করছে। হঠাৎ হঠাৎ থেমে ও যাচ্ছে লজ্জায়। ঠিক তখনই ওর বন্ধুরা শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায় হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে বলছে নাচো সুন্দরী নাচো। থামলে কেন?
নাচতে নেমে উঠান বাঁকা বললে চলবে!
সবাই দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
কনার চোখ ভিজে উঠতে চাইছে। ঠিক সেই মুহূর্তে একজন সুদর্শন পুরুষ এসে কনার চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, কাঁদছ কেন চাঁদের কনা?
এমন সুন্দরীদের চোখে পানি মানায় না। এসো আজ তোমাকে মন ভরে আদর করবো।
কনাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দোতলায়।
কনা স্বপ্নের মধ্যেই চিৎকার করে উঠল আমাকে ছেড়ে দাও। আমার একটা সুখের সংসার আছে। স্বামী আছে, বাচ্চা আছে।
কনার ঘুম ভেঙে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। ঘড়ির কাঁটা তখন দুটো বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। ঠিক সেই সময় তার মোবাইলে টুং করে একটা শব্দ হলো।
ম্যাসেজ আসছে। কনা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মোবাইলটা অন করলো। কবিরের ম্যাসেজ।
মিষ্টি সোনা
চাঁদের কণা
কি করো? ঘুম আসছে না? টাকা রেডি করেছো তো?
কাল ঠিক সকাল এগারোটায় রিভার ক্যাফেতে উপস্থিত থাকবে। মনে আছে তো? মাত্র পঞ্চাশ হাজার টাকা!
কনা মোবাইল সুইচ অফ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে খাবার রুমে গিয়ে ফ্রিজ থেকে এক বোতল ঠান্ডা পানি বের করে ঢকঢক করে পুরো বোতলের পানি খেয়ে ফেললো। তবু ও যেন তৃষ্ণা মেটে না।
বাকি রাতটা কনা বেলকোনিতে বসে কাটিয়ে দিল।
নিজের দোষে, নিজের তৈরি করা ফাঁদে আজ এমন ভাবে আটকে গেছে যে, কোন ভাবেই ফাঁদ থেকে বের হবার পথ খুঁজে পাচ্ছেনা।
আচ্ছা পাঠক হয়তো বুঝতে পারছে না, মূল ঘটনা আসলে কি? কনার মতো সুন্দরী, স্মার্ট, চৌকষ একটা মেয়ে কেন এতো ভয় পাচ্ছে? বোঝাই যাচ্ছে কেউ তাকে ব্লাকমেইল করার চেষ্টা করছে। ও চুপ করে এগুলো সহ্য করছে কেন? আইনী সহায়তা নিলেই তো পারে!
না পারে না।
কারণ আইনী সহায়তা নিতে গেলে ও নিজেই ফেঁসে যাবে। আর তোমরা যদি সম্পূর্ণ ঘটনা জানতে চাও। তাহলে ফিরে যেতে হবে তিন বছর আগে।
তখন উনিশ সাল। হঠাৎ করেই কনার এক কলেজ বন্ধু কনাকে ইনভাইট করলো ব্যাচ ভিত্তিক এক বিশাল গ্রুপে।
কনা ওর খুব সুন্দর একটা ছবি দিয়ে নিজের পরিচিতি পোস্ট দিল। দশ মিনিটের মাথায় আটশ নব্বইটা লাইক আর তিনশ পঁয়ষট্টি টা কমেন্ট!
কনা খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী টাইপের মেয়ে। ও আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে একটার পর একটা কমেন্ট রিপ্লাই দিচ্ছে।
এক ঘন্টায় থ্রি কে প্লাস লাইক!
শতো শতো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট!
কিছু কিছু বুদ্ধিমান মানুষ আছে যাদের বোকার মত দেখায়। যে কেউ কথা বলে ভাববে আরে মেয়েটা এতো সরল কেন! মনের মধ্যে কোন ঘোর প্যাচ নেই।
কনা হচ্ছে সেই রকম এক মানুষ।
ও প্রফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে হাই লেভেলের বন্ধুদের রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করলো।
এদের মধ্যে খুব পয়সা আলা কিছু বন্ধুদের সাথে নিয়মিত চ্যাট।
ছেলে বন্ধু গুলো ও কনার সৌন্দর্য দেখে পাগল প্রায়।
কনা ইনিয়ে বিনিয়ে এটা সেটা পছন্দ জানানোর সাথে সাথে কনার কাছে সেগুলো উপহার হিসেবে চলে আসে। বিষয় গুলো কনার কাছে খুব উপভোগ্য মনে হচ্ছিল।
যতো দিন যেতে লাগল, কনার বন্ধু সংখ্যা দ্রুত গতিতে বাড়তে লাগলো। ইদানিং কনা অনেক বন্ধু কেই ব্লাকমেইল করা শুরু করছে।
যারা কনা অন্তপ্রাণ হয়ে যখন যা মনে হয়েছে তাই বলেছে। কনা সেগুলো স্কিন শর্ট নিয়ে তাদের ভয় দেখানো শুরু করলো। ওর নাম্বারে নিদৃষ্ট পরিমাণ টাকা না দিলে আগামীকাল সব বন্ধু ভিত্তিক গ্রুপে এগুলো প্রচার করা হবে।
রীতিমত হুমকি!
যাদেরকে এই জাতীয় হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেকেই স্ব নামে পরিচিত। তারা ভেবেছিল সুন্দরী বান্ধবী। একটু সুযোগ বুঝে মজা করি। মেয়ে মানুষ নিজের সন্মাণের কথা চিন্তা করেই কাউকে কিছু বলবে না।
এখন তাদের মাথায় হাত। টাকা গেলে যাক। কিন্তু সন্মাণ নষ্ট করা যাবে না। ওরাও গোপনে কনার ডিমান্ড পূরণ করা শুরু করলো।
এতো সহজে এতো টাকা ইনকাম! কনার সাহস দুঃসাহসে রুপান্তরিত হলো।
কনা এখন লেখার চেয়ে ভিডিও কলে কথা বলে বন্ধুদের মনোরঞ্জন করে। যখন তখন বন্ধুদের ডাকে ছুটে চলে যায়।
বাইরে ঘোরা, নামকরা রেস্টুরেন্টে খাওয়া, দামী দামী শাড়ি গহনা কিনে বাসায় ফিরেই সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড দেওয়া ওর এখন নিয়মিত জব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেহেতু কনা খুব চতুর, তাই সে সুন্দর সুন্দর জায়গার ছবি আপলোড করলেও সাথে কে আছে তা উহ রেখে দেয়।
যারা কনার পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা ঢালে তারা সুযোগ বুঝে কনাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুলে। কনা সেই ছবি গুলো গুগল ড্রাইভে সেভ করে গ্যালারি থেকে ডিলিট করে ফেলে। যেন পরিবারের কারো নজরে না পরে এই ছবিগুলো।
এরপর যখন ধনী বন্ধুদের কনাকে আর ভালো লাগে না। অন্য বান্ধবী নিয়ে মেতে উঠে সেই ধনী বন্ধু গুলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে কনা এই ছবি গুলো দিয়ে হুমকি দেয়া শুরু করে
সব ফাঁস করে দিব!
বিষয়টা এমন স্পর্শ কাতর হয়ে দাঁড়িয়েছে যে লজ্জায় কারো সাথে শেয়ার করতে ও পারে না না।
অনেক ভুক্তভোগীই এখন কনার হাতের পুতুল।
কেউ কেউ ফেসবুক একাউন্ট ডি এ্যাক্টিভ করে রাখছে। কিন্তু তবুও মনে মনে ভয় পায় যে কখন কনা এইসব না প্রচার করে।
কনার ওপরে চোখ রাখতে ফেক আইডি খুলে গ্রুপে থাকার পাশাপাশি ওর নাম্বারটাও ব্লক লিস্টে। ব্লক লিস্টে কনার নাম্বার দেওয়ার মূল কারণ
কারণে অকারণে, সময়ে অসময়ে কনার হুমকি!
এমনি একজন ভুক্তভোগী শিল্পপতি শাহরিয়ার। কনার পেছনে সে কম টাকা খরচ করেনি। কিন্তু কনার এখন অবাস্তব দাবি তার নামে ঢাকায় একটা ফ্লাট কিনে দিতে হবে।
শাহরিয়ারের কাছে একটা ফ্লাট দেওয়া এমন কিছু নয়। কিন্তু শুধু মাত্র বাইরে ঘোরাঘুরি, শপিং আর খাওয়া এই কাজের জন্য একটা ফ্লাট বেশি হয়ে যায়।
সে কনাকে ম্যাসেজ দিয়েছিল তার সাথে এক রাত থাকার জন্য।
তাহলে শুধু ফ্লাট কেন? কনার সমস্ত ভরণ পোষণের দায়িত্ব সে নিবে।
আর এই ম্যাসেজ টাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে শাহরিয়ারের জন্য।
কনা এখন এই ম্যাসেজ দেখিয়ে হুমকি দিচ্ছে বারবার।
শাহরিয়ার কম ঘুঘু নয়। শিক্ষাগত যোগ্যতা তেমন না থাকলে ও শুধু মাত্র বুদ্ধির জোরে সে আজ এই পর্যায়ে।
শাহরিয়ার কনাকে হাতে রেখেছে। গতো সপ্তাহে ও বাইরে খাওয়া দাওয়া করে হাত ভরে শপিং ও করে দিছে। আর বলছে একটু সময় দাও কনা।
তুমি আমার কাছে কিছু চাইছো আর আমি দিব না তাই কি হয়!
ধানমন্ডি, গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় তোমার জন্য ফ্লাট খোঁজা হচ্ছে। আমি দালাল লাগিয়ে দিয়েছি।
শাহরিয়ার দালাল লাগিয়েছে কথা সত্য। কিন্তু সেটা ফ্লাট কেনার জন্য নয়, সে কবিরের সাথে চুক্তি করেছে কনাকে এমন এক ফাঁদে ফেলতে হবে যেন, কনা ভবিষ্যতে আর কোনো ছেলেকে যেন ব্লাকমেইল করার সাহস না পায়।
কবিরকে ম্যানেজ করা খুব সহজ ছিল না।
কবিরের সমস্ত খোঁজ খবর নিয়ে তবেই সে সরাসরি কবিরের সাথে যোগাযোগ করেছে।
ফোন বাজছে অনেকক্ষণ ধরেই। কবির ফোনের সামনেই বসে আছে। কিন্তু ফোন ধরছে না। কানের সামনে ফোন বাজলে যে কোন মানুষের বিরক্ত লাগতে পারে , কিন্তু কবিরের চেহারার মধ্যে কোন বিরক্ত ভাব নেই। সে নির্বিকার ভাবে বসে বসে হুইস্কি খাচ্ছে আর সিগারেট ফুঁকছে।
কবিরের বয়স হয়েছে। কিন্তু তাকে দেখে সেটা বোঝা যায় না। আকর্ষণীয় চেহারা, মাঝারি গড়নের কবিরকে যে কেউ প্রথম দেখায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশের যুবক ভাববে। কিন্তু এই জুলাই মাসে কবিরের বয়স ছেচল্লিশে পা দিবে।
সমস্ত মুখাবয়বে একটি ছেলেমানুষি ভাব আছে। তীক্ষ চোখের কারণে যা কখনো স্পষ্ট হয় না। বন্ধু মহলে চির সবুজ, প্রেম কুমার নামে খ্যাত এই কবির।
টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। কবির সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে রিসিভার তুলে ধরলো।
হ্যালো।
মাসুদ কবির?
ইয়েস কবির স্পিকিং।
আমি কি আপনার সঙ্গে একটি জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারি?
তার আগে আপনার নাম বলুন।
নাম বললে আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না।
আমি অপরিচিত কারো সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি না।
কবির নির্বিকার ভঙ্গিতে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। এটা প্রায় নিশ্চিত, লোকটি আবার ফোন করবে।
কবির ফোন অফ করে শুয়ে পড়লো। পেট ক্ষুধায় চো চো করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে হোটেলে গিয়ে খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া অনেক দিন ধরে ভালো কোন কাজ না পাওয়ায় পকেটের অবস্থা ও ভালো না। দুই মাসের বাড়ি ভাড়া বকেয়া পড়েছে।
চোখটা লেগে এসেছে ঠিক সেই মুহূর্তে কলিং বেল বেজে উঠলো।
কবির উঠে দরজা খুললো। এ্যাশ কালারের স্যুট টাই পরা এক ভদ্রলোক ঘাড়ে ল্যাপটপ ব্যাগ ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটি তার গমগমে পুরুষালি কন্ঠে বললো আমি কি ভেতরে আসতে পারি? কিছুক্ষণ আগে আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।
আসুন।
বলুন কি ব্যাপার?
আমাকে কিছুক্ষণ সময় দিতে হবে সব কিছু বুঝিয়ে বলার জন্য।
কবির হাই তুলতে তুলতে বললো আমার এখন খুব ঘুম পাচ্ছে। দশ মিনিটের মধ্যে বলতে পারলে শুরু করুন।
দশ মিনিটে হবে না। কমপক্ষে আধা ঘন্টা সময় দিতে হবে। তার জন্য আমি আপনাকে পে করব। আধা ঘন্টার জন্য পাঁচশ। সময় বাড়লে আরো পাঁচশ ।
কবিরের টাকার প্রয়োজন। সে মাথাটা দুই বার ওপর নিচ করে বললো, ওকে ফাইন শুরু করুন।
চা চলবে?
খাওয়া যায়।
কবির ইলেকট্রিক কেতলি অন করে দুই কাপ চা তৈরি করে ফেললো।
একটা কাপ আগন্তুকের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো, হ্যা এবার শুরু করুন।
আমি শাহরিয়ার শফিক। আপনার সম্পর্কে সব জেনেই আমি এখানে আসছি। আপনি আমাদের ব্যাচ ভিত্তিক গ্রুপ গুলোতে বেশ এ্যাক্টিভ। সেই হিসেবে আপনি আমার ও বন্ধু।
আমরা কি আপনি থেকে তুমিতে নেমে আসতে পারি কথা বলার সুবিধার্থে।
কবির ঠিক বুঝতে পারছে না ওনার উদ্যেশ্যটা কি। তারপরও স্মিত হেসে বললো শিওর।
কবির তুমি নিশ্চয় কনাকে চেনো?
আমাদের ব্যাচের দুর্দান্ত সুন্দরী কনা। যার ছবি পোস্ট করার সাথে সাথে বন্ধুদের মাথা নষ্ট হয়ে যায়।
মুহুর্তেই হাজার হাজার লাইক কমেন্ট।
এক কথায় সেলিব্রিটি কনা। যাকে সবাই এক নামে চেনে।
হ্যা চিনি। কনার সাথে আমার ভালো পরিচয় আছে। রিসেন্টলি একটা অনুষ্ঠানে ওর সাথে নেচেছিলাম। খুব ভালো নাচেও মেয়েটা।
ওর সাথে কখনো ইনবক্সে কথা হয়েছে।
দেখুন মিষ্টার শাহরিয়ার। আমার আসলে মেয়েদের ব্যাপারে ইন্টারেস্ট কম। আপনি কি বলতে চান সেটা সরাসরি বলুন।
আমি হলাম ভাড়াটিয়া প্রেমিক । যে আমাকে যতো বেশি টাকা দেয় আমি তার হয়ে কাজ করি।
চলবে..
রোকেয়া পপি