ভালোবাসার একটি রাত

0
230

ব্যাগটা ছুড়ে ফেলে দিলে বিছানার উপর। ব্যাগের ভেতরে
ছোটখাটো অনেক টাকা। টাকাগুলো ব্যাগ থেকে এলেমেলো ভাবে ছড়িয়ে
পড়েছে বিছানার চারপাশে। গায়ে জড়ানো জলপাই রংয়ের শাড়ীটাও খুব
মানিয়ে ছিলো শতরূপাকে। সেই শাড়ীটাও দ্রæত খুলে ফেলছে। শাড়ীটাও
তার প্রিয় ছিলো। সেটাও খুলে ছুড়ে ফেলে দিলে বিছানার এককোণে।
ঘরের প্রধান দরজা বন্ধ করে নাই। হঠাৎ পাশের ফ্লাটের ভয়ংকর লোকটার
কথা মনে পড়তেই, অপ্রস্তুত তড়িঘড়ি করে প্রধান দরজা বন্ধ করল
শতরূপা। শতরূপার আজ কি যেন হয়েছে। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির ২.৫
লিটার এক বোতল পানি বের করলো। পুরোটাই ঢকঢক করে গিলে
ফেললো। তবুও সে ঘামছে। নাগের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছতেই মনে
পড়লো শুভ্রর কথা। শুভ্র বলেছিলো- দেখিস শতরূপা তোর বর তোকে খৃুব
আদর করবে। শতরূপার বাঁকা ঠোঁট, যেন শিশির ভেজা জীবন্ত একটি
গোলাপ ফুল। সেই ঠোঁটে কিঞ্চিত লুকানো হাসি জেগে উঠে। তারপর
হতাশায় মুহুর্তে হাসিটুকু একরাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। পুরো এক
বালতি পানি দিয়ে নিজেকে ভিজিয়ে নিল। ¯œান এর প্রস্তুতি। তাই ঝরনার
নিচে আনন্দের জলে নিজেকে বিলিয়ে দিল পানির ¯্রেেতা। নিজেকে খুব
যতœকরে তার অঙ্গে থেকে অঙ্গে, মানে সর্বাঙ্গে সুগন্ধি সাবান মেখে গোসল
করলো। পড়ন্ত বিকেলে সুর্যের আলোয় উদ্ভাসিত তার রূপ-যৌবন। গুন-
গুন করে গান গাইতে-গাইতে সমস্ত শরীরে লোশন মেখে নিল। কাঁচা
হলুদের মতো উজ্জ্বল শতরূপার গায়ের রং। ফুরফুরে মনে সেই শরীরে বড়
একটি তোয়ালে এবং বাসন্তি কালারের ওড়না জড়িয়ে নিল। ড্রইংরুমের
হেলানো চেয়ারে একটি কবিতার বই নিয়ে বসে পড়ে। তখন প্রায় মাঝরাত
ছুঁই ছুঁই। কবিতা পড়ার পৃথিবীতে সে এখন সম্পূর্ন একা। একটু শান্ত ও
আনন্দিত। হাতের মোবাইলটি টোটালি অফ। শতরুপার এই বিষণœ
পৃথিবীতে সে বড় একা। কবিতার পড়ার মাঝে মাঝে একঝাঁক দুঃখ তাকে
গ্রাস করছে। এই বিশাল ফ্ল্যাটটিতে তার একা থাকতে হয়। অন্য কেউ
হলে হয়ত ভয় পেত, ভূত-পেতœী, প্রেতাত্মা ইত্যাদি ইত্যাদি। শতরূপা
এগুলোকে বিশ^াস করে না। তাই ভয় পায় না। সে মাঝে মাঝে ভূতের
ভয়ংকর ছবি দেখেও তাকে ডর-ভয় কিছুই আচ্ছন্ন করতে পারে না। সে
যখন তার ফ্ল্যাটের প্রধান দরজাটা বন্ধ করে তখন সে স্বাধীন ও সকল ভয়ডর দূর হয়ে যায়। কেননা তার কাছে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে সমাজের
কিছু কিছু মানুষ। মাঝরাতে শতরূপার কবিতা পড়ার প্রখরতা বেড়ে যায়।
সে খুব আনন্দ নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে। তখন মাঝরাত পেরিয়ে
গভীর রাত। শতরূপর চোখ ঘুমের জন্য টলমল করছে। কবিতার বইটি
তার হাতে ছিল। উত্তপ্ত বুক যেন তার ফুটন্ত যৌবন। লিওন দ্যা ভিঞ্চির
আঁকা সেই বিখ্যাত ছবির মতো বুকের গঠন। আলতো স্পর্শে সেই বুকের
উপর শান্তির এই কবিতার বইটি রেখে ঘুমিয়ে পড়ে হেলানো চেয়ারে।
হঠাৎ দরজায় ঠক্ ঠক্ শব্দ।
শতরূপা ঘুমের ঘোরে অস্পষ্ট বলে উঠে কে?
ঃ আমি স্বপ্নিল, তোমার স্বপ্নিল ।
ঃ মিথ্যে বলছো। তুমি স্বপ্নিল নও। তুমি সমাজের ভয়ংকর কোন
জানোয়ার।
ঃ না, সত্যি বলছি আমি স্বপ্নিল ।
ঃ আমি বিশ^াস করি না। তুমি আমাকে ফেলে চলে গেছো, ‘না ফেরার
দেশে। আমার ভুবনে আমি ভীষণ একা।’
(স্বপ্নিল একটু হেসে বলে ) এত অভিমান তোমার!
ঃ আমি কি ভিতরে আসবো?
ঃ কি আশ্চার্য ব্যাপার তুমি এসেই গিয়েছো। কিন্তু কিভাবে এলো। বাহিরের
দরজা তো বন্ধ ছিল।
(হোঃ হোঃ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে স্বপ্নিল) শতরূপার একদম কাছে গিয়ে
বলে- এই দেখ আমি তোমার কত কাছে। আমি সবসময়ই তো তোমার
পাশে থাকি। তুমি আমাকে দেখতে পাও না!
স্বপ্নিল একটু হেসে বলে ‘তুমি একা কেন? কাউকে তোমার ভুবনে নিলেই
পারতে।’

শতরূপা মুগ্ধ বিস্ময়ে স্বপ্নিলের দিকে তাকালো। চোখের এককোণে এক
ফোঁটা জল জমতেই সেটা মুছে ফেলে। ঘরের উপরে ছাদ বরাবর তাকিয়ে
বলে- “ভালোবাাসার অভিনয়-সবিনয় করে অনেকেই আমার ভুবনে
আসতে চায়। আমাকে বিষদ গবেষণা বর্ণনা করতে যেয়ে, তার রাজ্যে
রাজকন্যা বানিয়ে ফেলে। আমাকে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে। কথাগুলো
বলতেই হোঃ হোঃ করে হেসে উঠে…শতরূপা ।
স্বপ্নিল শতরুপার কথাগুলো শুনে খানিকটা অনমনে অভিমানে প্রশ্ন করে
‘বাহ্ তোমাকে খুব ভালোবাসে এই মানুষগুলো। তাদের কাউকে নিয়ে ঘর
বাঁধলেই পারতে।’
স্বপ্নিল এর কথাগুলো শুনে শতরূপ আবার কষ্ট পেলো। আভিমানী মেয়ে
শতরূপা চোখে কষ্টের জল মুছে এবারও বলল- ‘আমার ভালোলাগে না।
জানো স্বাপ্নিল ওরা ভালোবাসার কথা বলেই আমার হাত ছুঁয়ে ঠোঁট স্পর্শ
করতেই চায়, কোনটা ভালোবাসা কোনটা অভিনয় আমি সব বুঝি।
আমাকের তোমার ভালোবাসার সজ্ঞা দিতে হবে না।
স্বপ্নিল দেখল শতরূপা খুবই অসহায়। একটু গা ঘেষে শতরূপার মাথায়
হাত বুলিয়ে দিল। শতরূপা হাত দুটি ধরে একটি একটি করে আঙ্গুল
ফুটিয়ে ম্যাসেজ করে দিয়ে বলে ‘শতরূপা পাগলামি করো না, আমি এখন
অন্য ভুবনের বাসিন্দা। আমাকে তুমি ভুলে যাও।’
শতরূপা ভুলে যাওয়া শব্দটি শুনে চমকে উঠে। তড়িঘড়ি করে বলে উঠে
‘ভুলে যাও বললেই কি ভোলা যায়। স্বপ্নিল আমি তোমাকে ছাড়া আর
কাউকে আমার এই পৃথিবীতে ভালোবাসতে পারব না। অনেক মাতাল
আমার রূপযৌবনকে অফুরন্ত টাকা দিয়ে কিনতে চায়। আমি নিজেকে
অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করি তবুও আমি বিμি হই নাই। আমি মরে যেতে
চাই। তবুও না। এই পৃথিবীটাকে আমার একটুও ভালো লাগে না। তোমার
কাছে আমায় নিয়ে চলো। তুমি এত দূরে থাকো আমি সেখানে যেতে
পারছি না।’
তবুও স্বপ্নিলের দয় হলো না। স্বপ্নিল তাকালো শতরূপার বুকের দিকে।
টানটান যৌবন সেই বুকের উপর একটি ভালোবাসার কবিতার বই পরম
যতেœ ঘুমাচ্ছে। বইটির মলাটে লিখা অন্যভুবন। বইটির লেখক স্বপ্নিল।
খানিক হেসে স্বপ্নিল বইটিকে তার বুক থেকে সরিয়ে নিলো। আলতো
স্পর্শে শতরূপাকে হেলানো চেয়ার থেকে দুই হাত দিয়ে কোলে তুলে
নিলো। তখন মাঝরাত পেরিয়ে একটি নতুন ভোরের অপেক্ষায়। শীতের
কনকনে ঠান্ডা বাতাস বইছে। সে বাতাস শতরূপার ওড়না ছুড়ে ফেলে দেয়
ফ্লোরে। স্বপ্নিল ধীর ধীর বেডরুমের দিকে নিয়ে যায় শতরূপাকে।
মমতাভরা মনে বিছানায় শুয়ে দেয় শতরূপাকে। শতরূপা পা থেকে গরম
কাপড়ের জুতাটা খুলে দিলো। নকশি সুতোয় গাঁথা একটি কাঁথা জড়িয়ে
দিলো শতরূপার গায়ে। একটু মৃদ হেসে স্বপ্নিল ভাবছে ‘বড় অভিমানি
মেয়ে শতরূপা, একটি ছেলেকে কতটা ভালোবাসলে এমনটি হয়।,‘স্বপ্নিল
একটু আবেগ চোখে শতরূপার দিকে তাকালে, তখন চোখ এর বাঁধ বেয়ে
পানি জমে উঠেছিল। স্বপ্নিল নিষ্পাপ ভালোবাসা বুকে নিয়ে শতরুপার
মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। দু‘হাত দিয়ে শতরূপার গাল স্পর্শ করে কপাল
জুড়ে একটু চুমো দিলো। তারপর বুকভরা আত্মনাদ আর হতাশা নিয়ে
তড়িঘড়ি করে বিদায় নিয়ে ফিরে যাবে। তখন শতরূপা স্বপ্নিল এর হাত
ধরে বলে ‘চলে যাচ্ছে কেন? তুমি বড় স্বার্থপর, আমাকে একটুও
ভালোবাসো না।’
স্বপ্নিল তাকিয়ে দেখে বড় বিষণœ সুন্দর লাগছে শতরূপাকে। স্বপ্নিলের
মনের ভেতরটা খুব খারাপ লাগে। তবুও স্বপ্নিল শতরূপার কোন কথা
কর্নপাত না করে বলে উঠে ‘আমাকে যেতে হবে’।
ঃ আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে চলে।
স্বপ্নিল আবার শতরূপাকে বোঝাবার চেষ্টা করে বলে- তুমি কেন আমার
সাথে যাবে? তোমার মতো একজন আদর্শবান প্রতিভাবান মেয়ে এই
সমাজের খুবই প্রয়োজন। তুমি এই সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য
সংগ্রাম করো। তোমার এই মহৎকর্মের মাঝেই আমাকে খুঁজে পাবে।
শতরূপা আজ স্বপ্নিল এর কোন কথার পাত্তা না দিয়ে বলে- আমি তোমার
কোন কথা শুনতে চাই না, আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চলো আমি যাব,
যাব, যাব …।
স্বপ্নিল বুঝে যায় শতরূপার এই জেদ থামানো যাবে না। এটা ভালোবাসার
তীব্র আকুতি থেকে জন্ম নেওয়া জেদ। তবুও স্বপ্নিলকে যেতে হবে। তাই
সে শতরূপার দিকে আবার বিষণœ দৃষ্টিতে তাকালো। তারপর শতরূপার
হাতটি জোর করে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে- আসি, আমি আবার আসবো। আমি

যে তোমার আত্মা। আমাকে আসতেই হবে। কষ্ট পায় না শতরুপা। যখন
দেখতে মন চাইবে ঐ চাঁদের বুকে আমাকে দেখতে পাবে। আসি, আসি।
শতরূপা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না স্বপ্নিল এর চলে যাওয়াকে।
শতরূপার ঘুমের ঘোরে গোঙানোর চাপা কান্না। বুক থেকে কবিতার বইটি
পড়ে যায় পাশের টি-টেবিলে। ড্রইংরুমে টেবিলে রাখা গøাসটিও গেল
ভেঙ্গে। গøাস ভাঙ্গার শব্দে শতরূপা জেগে উঠে। চেয়ে দেখে কবিতার
বইটি মেঝোতে পড়ে আছে। শতরূপার চোখে পানি। তরিঘড়ি করে
করিডোরে ছুটে যায়। তখন ভোররাত, আকাশে ভরা পূর্ণিমার চাঁদটি প্রায়ই
লুকিয়ে যাচ্ছে। শতরূপা দেখতে পায় সেই চাঁদে স্বপ্নিল এর মায়াবি
চেহারা। আজ দিনটি ছিল স্বপ্œিল ও শতরূপার ভালোবাাসা দিবস। এই
দিনটিতেই স্বপ্নিল খুব কাছে এসেছিল শতরূপার। হাতদুটি ধরে বলেছিল-
পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাাসা তোমার জন্য। আমি আছি, পৃথিবীও আছে,
পৃথিবীর ভালোবাসাও আছে, শুধু দেবার মতো তুমি নেই। শতরূপার চোখ
শুধুই মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা অতীতকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। স্বপ্নিল বাইক
এক্সিডেন্টে-এ মারা গেছে প্রায় সাত বছর হবে…।

                                                                                                              জসিম উদ্দিন জয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here