স্বপ্নের আগমন

0
211

আলো যেদিন রাতে মিষ্টি মিষ্টি লজ্জা মেশানো হাসি নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলঃ শোন, একটা কথা বলি।

আরজু তার মুখের পানে চেয়েই বুঝেছিল এ কোন সাধারণ কথা নয়। আলোর মাথায় হাত দিয়ে চুলের মধ্যে আঙুল নাড়িয়ে চোখ নাচিয়ে জানতে চাইলোঃ কি বলো?

আলো যেন আরো লজ্জায় ডুবে গেল। মুখ থেকে চোখ ফিরিয়ে নিজেকে লুকাতে আরজুর বুকেই ঝাপিয়ে পড়ল। নিচু স্বরে বললঃ আন্দাজ করো তো।

কথা আবিষ্কারের দ্বায়িত্বটা এবার আরজুর কাধে এসে পড়লো। বুকের মধ্যে আরো নিবিড়ভাবে আলোকে জড়িয়ে ধরে আরজু বললঃ নিশ্চয়ই খুব ভালো খবর। সেটা তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই।

আবেগ আর খুশি আলো বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারে না। আর কোন ক্লাইমেক্স তৈরি না করে বলেই ফেললঃ কেউ তোমাকে বাবা ডাকার জন্য তৈরি হচ্ছে।

খাঁচার পাখি ছেড়ে দিলে তার উড়ালেই বোঝা যায় সে কতটা মুক্তির স্বাদ পেয়েছে। ঠিক তেমনি নিজের কথাগুলো দ্রুত বলে আলো তার মনের ভেতরের আনন্দগুলো খোলা আকাশে মুক্ত করে দিল। এটাই আলোর আনন্দ প্রকাশের ভঙ্গি। মিটিমিটি আলো নিয়ে জ্বলে থাকা জিরো বাল্বের উজ্জ্বলতা ছাড়িয়ে জোসনার আলোয় ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠেছে। এমনি চাঁদের আলোয় ধীরে ধীরে আলো মিলিয়ে যেতে থাকে আরজুর বুকের মাঝে।

এরপর থেকে তাদের সংসারে প্রতিটি রাত এসেছে আনন্দের বার্তা নিয়ে। মুখোমুখি বসে শুরু হয় তাদের নতুন এক পৃথিবী। এ পৃথিবীর পুরোটাই স্বপ্ন দিয়ে আঁকা। কোন শিল্পী যেন সযত্ন রং তুলির ছোঁয়ায় ছবির মত সুন্দর করে তুলেছে তার ক্যানভাস। সে ছবিতে শুধু হাসি শুধু আনন্দের স্রোতধারা বয়ে চলেছে। দিন যত গড়ায় স্বপ্নটা ততোই কাছে আসতে থাকে। তাইতো প্রতিদিন স্বপ্নের রং বদলায়। স্বপ্নের রংগুলো আরো রঙ্গিন আরো স্পষ্ট হতে থাকে। ‘স্বপ্ন’-ই হবে তাদের আদরের সন্তান।

সন্তানের অস্তিত্বের অনুভূতি নিতে দু’জন দিশেহারা। এটা নেশার মত তাদের রুটিন ওয়ার্ক হয়ে গেছে। একজন কান পেতে শুনতে অন্যজন শোনাতে। আগত সন্তানের টগবগিয়ে ওঠা একটু শব্দ কানে পেতেই ধেইধেই করে নেচে ওঠে আরজুর সমস্ত দেহ মন প্রাণ। আর সেটা দেখে আলোর মুখোমন্ডল খুশিতে আলোকিত হয়ে ওঠে। লজ্জা মেশানো চোখ মুখে হাত রেখে বলে ‘পাগল একটা’। এমনি উক্তি আরজুকে আরো উৎসাহিত করে তোলে। নতুন করে আবার শুরু হয় নতুন কোন খুনসুটি। এভাবে কত রাত যে আনন্দের ভেলায় পাড়ি দিয়ে সকালের দুয়ারে ঠেকেছে তা টেরই পায়নি দু’জন।

স্বপ্নের সিঁড়ি বেয়ে সময় পেরিয়ে যায় । এক এক করে ছ’টি মাস শেষ হয়েছে। রঙ্গিন স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবতার সাথে মিলিত হতে নামতে থাকে পৃথিবীর বুকে।

স্বপ্ন-দ্বীপে উড়ে বেড়ানো জাহাজটা কিভাবে বন্দরে নামবে এখন সেটা নিয়েই যত ভাবনা। আরজুর মন দুঃশ্চিন্তার জালে আটকা পড়তে থাকে। আলো সত্যিই আমাদের স্বপ্নকে সুষ্ঠুভাবে ভূমিষ্ঠ করাতে পারবে তো?

নিয়মিত চেক আপের কমতি নেই।সাত মাস পেরিয়েছে কিছু দিন আগে। শেষের চেক আপে বেশ কিছু জটিলতা ধরা পড়েছে। সময়ের সাথে মায়ের পেটে স্বপ্ন বেড়ে উঠেছে ঠিকই কিন্তু অবস্থানটা কিছুটা অস্বাভাবিক। স্বপ্নের অবস্থানে ফ্র্যাঙ্ক ফ্রীচ ধরা পড়ে। মাথার দিকটা নিচের দিকে থাকার কথা থাকলেও সেটা আছে ওপরের দিকে। সাধারণ কথায় যাকে উল্টা পজিশন বলে।

আরজু ও আলোর পরিবারের মানুষদের মনের আনন্দ উড়িয়ে দিয়ে চিন্তা আর উদ্বিগ্নতা এসে সে জায়গাটা দখল করে নিয়েছে। আরজুর রাত জাগা চোখ দুটো এখন আর আনন্দের জোয়ারে ভাসে না। সে চোখে চঞ্চলতা নেই আছে স্থিরতা আছে চিন্তা আছে ক্লেশ। জীবনে বয়ে যাওয়া আনন্দের মূহূর্ত গুলো স্মৃতির পাতায় স্থান করে নিতে চাইছে। মনের কোণে কেবলই জেগে ওঠে তাদের স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নেবে তো? আলো আঁধারের গহ্বরে হারিয়ে যাবে নাতো?

ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে চলতে থাকে ফিজিক্যাল ট্রিটমেন্ট। এই কয়েকটা দিন আরজুর কাছে মনে হয়েছে বছরের সমান। আর প্রতিটা বছরই এসেছে বিষাদে ভরা মন্ত্র নিয়ে। অবশেষে ডাক্তার জানিয়েছে সকল অন্ধকার দূরে ঠেলে আলো তার স্বপ্নকে নিয়ে সুন্দর ভাবে পৃথিবীকে আলোকময় করতে রেডি।

আশা নিরাশার দোলায় দুলে এক মধ্য রাতে আলোর দুয়ারে লেবার পেইন কড়া নাড়ে। সার্জারি রুমের বাইরে পরিবারের সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আজ আরজুর দু’পা বড়ই চঞ্চল। অজানা আশঙ্কা তাকে স্থির হতে দেয়না। এতদিনের সংসার প্রেম ভালবাসা কেবল একটি স্রোত কি কেড়ে নিয়ে যাবে? হারিয়ে যাবে কি সমুদ্রের গভীর অতলান্তে? আলো বিহীন আরজুর জীবন কি আঁধারের গভীরে হারিয়ে যাবে? আরো কত চিন্তার স্তুপ তার মাথাকে ঘিরে ফেলেছে। উদ্বিগ্ন চোখ দুটি ঘনঘন অপারেশন থিয়েটারকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। গভীর রাত ছুটে চলেছে আঁধারের যবনিকায়।আরজুর শরীর, চক্ষুপল্লব ধীরে ধীরে ভারি হয়ে আসছে। চেতন- অবচেতনের খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে তার দুনিয়া। এভাবে হয়তো কেটেছে অনেকক্ষণ। অপারেশন থিয়েটারে নেয়ার সময় আলো আরজুর হাত দুটি ধরে ধরা গলায় বলেছিলঃ যদি আর ফিরে…….
আরজু মুখে একটু হাসি আনার চেষ্টা করে সুমধুর ভাবে কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেজা কন্ঠেই বলতে হয়েছেঃ ভয় পেয় না। দেখ তুমি আমাদের স্বপ্নকে সাথে নিয়েই ফিরবে। আমার ভালবাসা তোমাকে ভাল লাগবে সব সময়।

ওটি রুম থেকে ভেসে আসা সদ্যজাত শিশুর কান্না আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ কান্না আনন্দ প্রকাশের কান্না। এ কান্না আরজুর দুনিয়ায় অবস্থান নেয়া দুঃখ বেদনাকে বিতাড়িত করার সংকেত। এ কান্নার আওয়াজ শুনেই মূহুর্তেই কষ্টেরা যেন তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়ে যায় দূর গভীর জঙ্গলে। আরজু তার দেহ মনকে ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে স্বপ্ন হেসে ওঠে আরজুর কোলে। এ হাসি ভুবন ভোলানো হাসি, এ হাসি আকাশে বাতাসে ঢেউ খেলানো হাসি, এ হাসি জীবনে রং ছড়ানো হাসি, এ হাসি পূর্ণতার হাসি। স্বপ্ন ফিরে যাচ্ছে ওটি রুমে। সেখানে নরমাল ডেলিভারির কৃতিত্ব নিয়ে আলো অপেক্ষা করছে।

হাসপাতালের মসজিদ থেকে ভেসে আসে ফজরের আজানের ধ্বনি। আরজু ফিরে তাকায় পূবাকাশের দিকে। তখন আধারেরা সব তাদের পৃথিবীতে ফিরে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সূর্য ওঠার বার্তা নিয়ে রক্তিম আভাগুলো মাথা উঁচু করে নতুন দিনের আগমনী জানান দিচ্ছে।

                                                                                                              (মোঃ এনামুল হক)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here