চ্যালেঞ্জ ভরা শহরে
কল্লোল_মাহমুদ
কায়রোর হোটেলে পৌঁছে তিনগুন বেশি টাকা দিয়ে শুধু এক রাতের জন্য রুম পেলাম।
রুমের জানালা খুললেই রাতের নীল নদ। মন কেমন করা ঝিরিঝিরি বাতাস আর মায়াবী চাঁদ।
তারপর আমাদের কাজ হলো আগামী রাতে কোথায় থাকবো -সেটা খুঁজে বের করা।
ইন্টারনেট ঘেঁটে একটি মোটামুটি মানের হোটেল পেলাম।
পরদিন নাস্তা খেয়ে সেই নতুন হোটেলে চেকইন করলে পরে ওঁরা জানালো, দুই রাতের জন্য ওঁরা রুম দিতে পারবে। ১৫তারিখ থেকে কায়রোতে কিসের যেন অনুষ্ঠান, তখন সকল হোটেলের রুম সব বুকড।
আবারো গবেষণায় বসলাম।
“মিশর ভ্রমণ” পরে ভেবে দেখা যাবে, কোথায় রাতে ঘুমাবো এই চিন্তায় অস্থির আমরা।
আমার সুইস কলিগরা বলেছিলো: মিশর গেলে যেন সমুদ্র-সৈকতের শহর “হুরগাদা” অথবা “শার্ম এল শেইখ”-এ বেড়াতে যাই।
আর অবশ্যই যেন পাঁচ তারা হোটেলে থাকি।
মিশরের পাঁচ তারা মানে প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের তিন তারা। খরচ কমাতে মিশরের তিন তারা হোটেলে থাকলে ঝুঁকি থাকে। রাতে না ঘুমিয়ে পাহারাদারের ডিউটি করতে পারবেন।
ঠিক করলাম: কায়রো ছেড়ে লোকাল-প্লেনে করে শার্ম এল শেইখ চলে যাবো। আধা ঘন্টার এই বিমানযাত্রায় খরচ জনপ্রতি ৬০ডলার এর মতন। শার্ম এল শেইখ এর সমুদ্র তীরের “পাঁচ তারা” রিসোর্টে চার রাতের জন্য দাম চাইছে জনপ্রতি দুইশো বিশ ডলার। এর মধ্যে তিন বেলা খাওয়া-যতখুশি ঠান্ডা-গরম পানীয় -সবই অন্তর্ভুক্ত।
বুকিং শেষে বের হলাম কায়রোর জাদুঘর দেখতে।
কায়রোতে দুটি জাদুঘর প্রসিদ্ধ: NMEC (The National Museum of Egyptian Civilization) এবং The Egyptian Museum. তৃতীয় আরেকটি নতুন ও বিশাল জাদুঘর তৈরী হচ্ছে পিরামিডের বাগানের কাছেই।
The Egyptian Museum টি ১৯০২ সাল থেকে সাধারণের জন্য উন্মুক্ত। তাহরির প্লাজার কাছের সেই জাদুঘরটি দেখতে গেলাম আমরা।
বিশাল এই জাদুঘরটি কিছুটা প্যারিসের ল্যুভ জাদুঘরের কথা মনে করিয়ে দেয়। ফারাও দের অলংকার, বস্ত্র, আসবাবপত্র, জুতা-স্যান্ডেল যেমন দেখলাম, তেমনি আছে সোনার কারুকাজ করা মমি রাখার বাক্স -কয়েক স্তরের।
মিশরের ফারাওরা যেমন চাইতেন নিজেদেরকে মমি করে রাখতে, তেমনি তাঁদের অধীনস্ত আমলা, সেনাপতি, পুরোহিত -তাঁরাও চাইতেন “মমি” হতে
-তবে অবশ্যই মৃত্যুর পরে।
সেজন্য মমির বাক্স অনেক আগে থেকেই অর্ডার করতে হয়, কবর পাহারা দেবার জন্য অতিকায় প্রস্তর খন্ডের দেবদেবীর মূর্তি বানাতে হবে, … আরও কত আয়োজন।
এমনও হয়েছে যে ফারাও-রাজপুত্রের কেবল জন্ম হয়েছে, শুরু হয়ে গেলো পিরামিড বানানোর আয়োজন-রাজপুত্র বুড়ো হয়ে মরলে পরে যেথায় শুয়ে থাকবে।
অভিজাত মিশরীয়দের জীবনের অনেকটাই কেটে যেত মৃত্যুর পরের জীবনের সুখ-সাধনায়। তাঁদের চাহিদা মেটাতে জীবন পিষে শ্রম দিতো লক্ষ-কোটি দাসেরা। অতিকায় শিলাখণ্ড দিয়ে দেব-দেবীদের মূর্তি বানাতে গিয়ে কিংবা পিরামিডের পাথর তুলতে গিয়ে চাপা পড়ে শয়ে শয়ে মৃত্যু হতো এদের।
জীবিত ও সুস্থ তরতাজা দাসদের ছিল “মর্মান্তিক সৌভাগ্য” -কিছু ফারাও-রাজার আমলে এমন দাসদের জ্যান্ত ধরে মমি করে শুইয়ে দেয়া হতো রাজা-রানীর মৃতদেহের মমির সাথে।
রাজা-রানী পুনর্জীবিত হলে ফাইফরমাশ খাটার জন্য দাস লাগবে -সে জন্যই এই ব্যবস্থা।
জাদুঘরে আরও দেখলাম: মমি করা অভিজাত ব্যক্তি ভবিষ্যতে জেগে উঠে কি খাবেন -সেটাও সে যুগের “টিফিন বাক্সে” সাজিয়ে রাখা। হাজার বছরে সেই খাবারও শুকিয়ে মমি হয়ে গিয়েছে !
মনটা খারাপ হলো “মমি” দেখে।
যাঁর মমি- তিনি কোনো এক সময় এই পৃথিবীতে ছিলেন, হাসি-খেলায় কেটেছিল তাঁর দিনগুলো।
হাজার বছর পরে তাঁর শীর্ণ-শুকনো মুখের করুন চাহনি দেখে বিষন্ন হয়ে পড়লাম।
প্রতিদিন শত-সহস্র ট্যুরিস্ট আসছে-এই মমিদের সাথে সেলফি তুলছে।
মমিটি একজনের মৃতদেহ, তাকে সম্মানের সাথেই আড়ালে রাখা উচিত। সাধারণের জন্য তাঁকে উন্মুক্ত রাখাটা মৃতদেহের জন্য সম্মানজনক নয়।
সেজন্য মমির কোনো ছবি দিলাম না এই পোস্ট এ।
পিরামিডের বাগান -এটিও মূলতঃ একটি কবরস্থান। অথচ সেখানে এখন পাকা রাস্তা বানিয়ে নানান জায়গায় কফিশপ বানানো হয়েছে। স্যুভেনির, কাপড়চোপড় আরও কত কিছুর দোকান ও মেলা বসেছে।
বাতাসে উড়ছে পলিথিন ও চিপসের প্যাকেট!
আমি অবাক, দেশবিদেশের এতো লোকের কেন কবরস্থানে ঢুকে কফি পান করতে হবে? কেন গলার মাফলার কিংবা ঘরের থালাবাসন পিরামিডের পাশ থেকেই কিনতে হবে?
যে দেশেই হউক -মৃতদেহ ও কবরস্থান নিয়ে ব্যবসা -মন মেনে নিতে চায় না।
কায়রোতে আর কোথাও গেলাম না।
পরদিন আড়াই ঘন্টা আগে থেকেই রওনা হলাম কায়রো এয়ারপোর্টের পথে।
শুরু হলো চ্যালেঞ্জের নতুন পর্ব।
পুরোটা রাস্তা গাড়িতে ভরাট। কোথাও ঠাঁই নেই। উবারে ঠিক করা আমাদের গাড়ি হোটেল থেকে বের হয়ে কিছুদূর গিয়ে আর আগায় না।
চিন্তায় পরে গেলাম। হাতে দুই ঘন্টারও কম সময় বাকি।
ড্রাইভার ফাঁক-ফোকর দিয়ে অবশেষে একটা সিগন্যালের কাছ পর্যন্ত এলেন। ট্রাফিক পুলিশ আর কাউকে যেতে দেবেনা সামনে।
কারণ কোনো একজন ভিআইপি যাবেন বিমানবন্দরের দিকে। হতে পারে মিশরের প্রেসিডেন্ট।
তাই পুরোটা রাস্তার এক পাশ আটকানো। জায়গায় জায়গায় সিকিউরিটির লোকজন ওয়াকিটকি হাতে পাহারা দিচ্ছে।
পরিচিত দৃশ্য -এসব দেখেই বড়ো হয়েছি।
চিন্তায় পড়লাম -এভাবে আটক থাকলে প্লেন ধরতে পারবো না।
তখন কায়রোতে থাকতে হবে।
কিন্তু কোনো হোটেল খালি নেই।
প্লেন মিস হলে আজকে রাতে কোথায় থাকবো? তারপর??
টেনশনে দুজনে ঘামছি।
হঠাৎ পাশ দিয়ে এক মোটর সাইকেলে চড়ে তিনজন ষণ্ডামার্কা যুবক আমাদের গাড়্রির পাশে এসে দাঁড়ালো।
চোখে সানগ্লাস। মুখে মাস্ক-মাথায় রাজনৈতিক দলীয় কোনো পট্টি বাঁধা।
ঢাকা শহর হলে অন্যকিছু ভাবতাম। অবশ্য আমার মতন কৃপণ লোকের কাছে থেকে নেবার মতন কিইবা আছে ?
ওঁরা এসে আমাদের গাড়ির দিকে তাকালো। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে ট্রাফিক-পুলিশকে বললো – ওঁদেরকে রাস্তা ছেড়ে দিতে।
পুলিশ রাজি ছিল না।
একজন হুংকার দিয়ে সরকারি দলীয় কোনো এক অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র দেখালো।
তখন পুলিশ ব্যারিকেড সরাতেই ……….
আমাদের উবার ড্রাইভার এক্সিলেটরে দিলো কষে এক চাপ:
“ভোঁ” করে ব্যারিকেডের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে গেলো আমাদের গাড়ি।
পিছে পুলিশ চেল্লাচ্ছে -কে শোনে কার কথা !
পুরোটা রাস্তার অন্য পাশে তীব্র জ্যামে আটক পড়া গাড়ির জট। আর আমাদের পাশটি সেই ভিআইপির জন্য ফাঁকা রাখা।
গাড়ি ছুটছে। রাস্তার পাশের সিকিউরিটির লোকজন হতবাক -এরা কারা যায়? দু একজনের স্বভাববশতঃ হাত উঠে গেলো সেলুট দেবার জন্য।
গাড়ির সামনে আমি সানগ্লাস পরে বসা -হয়তো ভাবছে টাকমাথা এই লোকটি হলো বডিগার্ড।
পিছে বসা আমার “ফার্স্ট-লেডি”!
পনেরো মিনিটে পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টে। আনন্দ আর ধরে না !
ঝামেলা তখনও কিছু বাকি।
এয়ারপোর্টের ভিতরে ঢোকার মুখেই সিকিউরিটি চেক-এর লম্বা লাইন। সেই লাইন ধরে আধা ঘন্টায় ভেতরে ঢুকলাম। প্লেনের কাউন্টার খুঁজছি -ইংরেজি কেউ বোঝে না। দু তিনজন বললো যে ওদিকে যান -আরেকটি সিকিউরিটি চেক সেরে ইমিগ্রেশন পেরিয়ে এরপরে “এয়ার কায়রো”র কাউন্টার পাবেন।
সিকিউরিটি চেক পার হয়ে ইমিগ্রেশন পার হবো -কি মনে করে পুলিশ কে টিকেট দেখিয়ে বললাম যে “এয়ার কায়রো”র কাউন্টারটা কোথায়?
“এটাতো ইন্টারন্যাশনাল অংশ, আপনাদের টিকেটের জন্য যেতে হবে বিমানবন্দরের লোকাল অংশে।
কিন্তু এখন আপনারা তো ওদিকে আর ফিরতে পারবেন না।
ইমিগ্রেশন পেরিয়ে আপনাদেরকে এখন মিশরের বাইরে চলে যেতে হবে।” -পুলিশের উত্তর।
কি বিপদ! কোথায় যাবো এখন? এঁরা কিছুতেই আর ফিরতে দেবে না। আমাদের প্লেন ছাড়তে আর মাত্র পঁয়ত্রিশ মিনিট বাকি।
দুজন দুদিকে পাগলের মতন ছুটছি -যাকে-তাকে অনুরোধ করছি।
অবশেষে একজন পুলিশ অফিসারের মনে দয়া হলো। সিকিউরিটির দায়িত্বরত পুলিশদেরকে অনুরোধ করে আমাদেরকে আবারো ফিরতে দিলো লোকাল এয়ারপোর্ট অংশে।
দৌড়ে গেলাম এয়ার কায়রোর কাউন্টার-এ। তেমন মানুষজনের ভিড় নেই।
প্লেন কি ছেড়েই চলে গেলো?
অফিসার আশ্বস্ত করলেন: ঐ প্লেন ছাড়বেই না।
ওটা বাতিল হয়ে গিয়েছে।
তাহলে এখন কি উপায়?
তিনি দুই ঘন্টা পরের ফ্লাইট -এ আমাদের জন্য ব্যবস্থা করে দিলেন।
শার্ম এল শেইখ-এ পৌঁছে রিসোর্টে ঢুকে আমরা বিস্মিত।
এত্তো সুন্দর এই পৃথিবীটা!
জীবনে চ্যালেঞ্জ থাকবেই -চ্যালেঞ্জ টপকে এমন অপার বিস্ময়কর সৌন্দর্য দেখলে স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায় অবনত হতে হয়।