রহস্যময়একটিরাত
কলমে রোকেয়া পপি।
কাজটা যতোটা জটিল হবে ভেবেছিলাম ততোটা জটিল হলো না। এতো সহজে এই সুন্দর বাসাটা পেয়ে যাব ভাবতেই পারিনি। আমাদের বাজেটের সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটা ছোট্ট বাসা খুঁজছিলাম। ঠিক যেন আমার মনের মত এই বাসাটা। বেড রুমের সাথে ছোট্ট এক চিলতে বারান্দা। তাও আবার দোতলায়! এতো কম ভাড়ায় ঢাকা শহরে বাসা ভাবাই যায় না।
আমাদের নতুন সংসার। নতুন বাসায় উঠৈ গুছিয়ে নিতে খুব একটা সময় লাগলো না। জাফর সারাদিন অফিসে থাকে। আমি একা মানুষ। সবসময় বাসায় থাকি। তাছাড়া এ বাড়ির কেয়ারটেকার আমাকে একটা অল্প বয়সী ছুটা বুয়া ঠিক করে দিয়েছে। জরিনা নামের মেয়েটাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ও নাকি আবার এক বাচ্চার মা!
জরিনার সাহায্য নিয়ে দুই দিনেই আমার স্বপ্নের বাসা গোছানো শেষ। আমার বেড রুমের সাথে এক চিলতে বারান্দায় যখন দুটো চেয়ার আর ছোট্ট একটা টেবিল সেট করলাম, তখন জরিনার চোখে মুখে কেমন যেন একটা ভয় দেখেছি। ও কেমন আমতা আমতা করে বলছিলো, ভাবিসাব যদি বেয়াদবি না নেন একটা কথা কইতাম।
বলো জরিনা। তোমার যখন যা বলতে মন চায় মন খুলে বলবে। কোন সংকোচ করার দরকার নেই।
ভাবিসাব চেয়ার টেবিল এই বারান্দায় না দিলে হয় না?
কেন এই বারান্দায় দিলে সমস্যা কি? এই বারান্দাটা আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। আমি সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ কিনে এনে সাজাব। দেখবে তখন কেমন চেহারা পাল্টে যায় এই বারান্দার।
আমি ঠিক করেছি এখানে বসে প্রতিদিন সকাল আর বিকেলের চা খাব।
আফনের ইচ্ছা। তয় যতো কম আইবেন এইহানে, ততোই মঙ্গল। এই পাশটায় দোষ আছে।
কি বলো! দোষ আছে মানে?
না না কিছু না ভাবিসাব। এমনিতেই কইলাম। জরিনা জিভ বের করে কানে ধরে ছুটে চলে যায় মুনার সামনে থেকে। ওর হঠাত করেই মনে পড়ে যায়, দারোয়ান বারবার করে সাবধান করে দিয়েছে উল্টাপাল্টা কথা না বলতে। এর আগে দু দুটো ভাড়াটিয়া চলে গেছে।
জরিনার এমন উদ্ভট কথা শুনে আমি মনে মনে হাসি।
আমার খারাপ লাগছে না নতুন বাসা, নতুন পরিবেশ।
শুধু ভর দুপুরে বারান্দায় আসলে গা কেমন যেন ছমছম করে। জরিনা সকালে এসেই ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে সব কাজ শেষ করে চলে যায়। এরপর আমার দীর্ঘ অবসর। সময় কাটানোর জন্য গল্পের বই পড়ি। গোছানো আলমিরার সব কাপড় বের করে আবার গুছাই। জাফরের জন্য নতুন নতুন রান্না করি ইউটিউব ভিডিও দেখে। দুপুরে একটা ভাত ঘুম দেই প্রতিদিন। আজ কেন যেন ঘুম আসতে চাইছে না। আকাশটাও বেশ মেঘলা। গুমোট একটা ভাব ধরে আছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে।
আমি একটা ভুতের গল্প পড়ছিলাম। নির্জন দুপুরে ভৌতিক গল্প পড়তে গিয়ে এমনিতেই কেমন যেন একটা ভয় ভয় করছিলো। তার মধ্যে হঠাৎ করে শুনতে পেলাম কান্নার শব্দ। কি করুন সুরে কোন মেয়ে কাঁদছে। আমি বইটা বন্ধ করে কান খাড়া করে বোঝার চেষ্টা করছি কোথা থেকে শব্দ আসছে। মনে হচ্ছে আমার সামনের বাসা থেকে কান্নার শব্দটা আসছে।
আমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের ডুপ্লেক্স বাসার ভেতরের অনেক কিছুই দেখা যায়। অধিকাংশ সময় জানালা বন্ধ থাকে। কখনো খোলা থাকলেও ভারি পর্দা ঝুলে। কখনো আমার চোখে কাউকে পড়েনি এই এক মাসের মধ্যে। আমার প্রায় সময়ই মনে হয় ঐ বাসায় যদি আমার মতো একটা মেয়ে থাকতো, তাহলে দুজনে মিলে বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যেতো।
আমি ভয়ে ভয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বেলকোনির সাথে রুমটার পর্দা বাতাসে সরে যাওয়ার সাথে সাথে দেখলাম সুন্দর মতো একটা মেয়ে গালে হাত দিয়ে শব্দ করে কান্না করছে আর বলছে শেষ পর্যন্ত আমার গায়ে হাত তুললে!
ছেলেটা তখন বলছে, হ্যা তুললাম। এরপর যখন আবার অবাধ্য হবে তখন শুধু একটা চড় নয়, শাস্তি আরো ভয়ঙ্কর হবে।
ইস মেয়েটা কেমন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমার খুব ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখতে। এই সময় শুরু হলো আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বৃষ্টি আর ঝড়ো হাওয়া।
আমি রুমে এসে দরোজা জানালা ছুটাছুটি করে বন্ধ করলাম। মনটা খুব খারাপ লাগছে। আচ্ছা কিছু দিন গেলে কি জাফর ও আমার সাথে ঠিক এমন খারাপ ব্যবহার করবে! গায়ে হাত তুলবে!
সন্ধ্যায় ঝড় বৃষ্টির প্রকোপ কমে আসতেই জাফর চলে আসলো। ও দরোজা নক করছে, কলিং বেল চাপছে। কিন্তু আমার ভয়ে এমন অবস্থা হয়েছে, যে মনে হচ্ছে দরোজা খুললেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে।
জাফর যখন অস্থির হয়ে বার বার বলছিলো, কি হয়েছে মুনা? আমি জাফর, দরজা খুলছো না কেন?
জাফরের কষ্ঠ শুনে আমি ছুটে গিয়ে দরজা খুলে জাফরকে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরলাম যে, জাফর বিস্মিত হয়ে বললো, কি হয়েছে? ঝড় বৃষ্টিতে একা থাকতে ভয় লাগছিল?
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যা বলাতে জাফর হো হো শব্দ করে হেসে উঠে বললো, আচ্ছা পাগলি আছো তুমি। নিচে দারোয়ান আছে। ঘরের দরোজা আটকে রাখছো। তাহলে ভয় কিসের?
জাফর আসার পর নিজের ছেলে মানুষি দেখে নিজেরই খুব হাসি পাচ্ছিল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই রাতের খাবার খেয়ে সামান্য খুনসুটি করে দু’জনে ঘুমাতে গেলাম। রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দার দরজাটা খুলে রেখে ঘুমালাম, ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাস ছেড়েছে বৃষ্টি থামার পর। ঠান্ডা আবহাওয়ায় খুব সহজেই ঘুম চলে আসলো। মাঝ রাতে আবার সেই কান্নার শব্দ! আমি ঘুম ঘুম চোখে জাফরকে ডাকলাম এই শুনছো?
ও ঘুম জড়ানো কন্ঠে চোখ না খুলেই বললো কি হয়েছে? বলেই আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। বুঝলাম ও ঘুমের মধ্যেই কথা বলছে। আমি আস্তে করে ওর হাতটা সরিয়ে নেমে আসলাম। বারান্দায় যাওয়া মাত্র মনে হলো সামনের বেলকোনি থেকে কেউ ছুটে ভেতরে চলে গেল।
সাথে সাথে একটা ঠান্ডা বাতাস এসে আমার পুরো শরীর হিম হয়ে গেলো। পরিবেশটা কেমন যেন ভৌতিক! মনে হচ্ছে আমার পায়ের তলায় শেকড় হয়ে আটকে গেছে আমার পা। আমি কিছুতেই পা উঠাতে পারছি না। খুব করে চাইছি ছুটে আমার রুমে চলে যেতে। কিন্তু আমি এক পাও নড়াতে পারছি না। আমি চিৎকার করে জাফরকে ডাকতে চাইছি। কিন্তু গলা দিয়ে এক ফোঁটা শব্দ বের হচ্ছে না!
ভয়ার্ত চোখ দুটো দেখতে না চাইলেও দেখতে পাচ্ছি। একদম স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছি সামনের বাসার বেডরুমে কি ঘটতে চলেছে।
ছেলেটি মাজার বেল্ট খুলে মেয়েটাকে ইচ্ছে মতো বারি দিচ্ছে আর বলছে, সুপ্রভা তোমার এতো সাহস হয়েছে। আমি বলেছি তুমি আর গান গাইতে পারবেনা। তারপরও তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে গিয়ে রেডিওতে গান গেয়ে আসছো! আজ তোমার একদিন তো আমার একদিন।
মেয়েটি হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, সুদীপ্ত প্লিজ আর মেরো না। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। এই তুমি তো আমার গান শুনেই পাগল হয়েছিলে আমাকে বিয়ে করতে। তবে এখন কেন এমন করছো আমার সাথে? তুমি জানো গান আমার জীবন মরণ। বাবা সেই ছেলে বেলা থেকে কতো যত্ন করে বড়ো বড়ো ওস্তাদ জি রেখে আমাকে গান শিখিয়েছে। সেই গান আমি কিভাবে ছাড়ি!
চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে হিসহিসিয়ে সুদীপ্ত বলছে,
কিভাবে ছাড়ি, তাই না? আজ তোর একদিন তো আমার একদিন। বল গান ছাড়বি? না পরে পরে আমার হাতে মার খাবি? আর শোন আমি তোর গান শুনে পাগল হয়ে তোকে বিয়ে করিনি। বিয়ে করেছি তোর এই বাড়িটার লোভে।
আহ্ লাগছে সুদীপ্ত। চুলের মুঠি ছাড়ো। এই বাড়িটা আমার নামে। বাবা মারা যাওয়ার সময় তোমার হাতে তুলে দিয়ে গেছিল আমাকে দেখে রাখতে। এই তোমার নমুনা আমাকে দেখে রাখার! তুমি এই মুহূর্তে আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাবে। আমি তোমাকে ছাড়তে পারি, কিন্তু গান ছাড়তে পারবো না।
ও তাই না। তুই গান ছাড়বি না! আমি এ বাসা থেকে বের হয়ে যাবো! এতোই সস্তা! দাড়া দেখাচ্ছি মজা।
সুদীপ্ত রান্না ঘরে গিয়ে কেরোসিন তেলের গ্যালন আর ম্যাচ নিয়ে এসে সুপ্রভার গায়ে তেল ঢেলে দিয়ে একটার পর একটা কাঠিতে আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করছে, আর কোথা থেকে বাতাস এসে নিভে যাচ্ছে।
সুপ্রভা মেয়েটা হাত জোড় করে কান্না করছে আর বলছে প্লিজ সুদীপ্ত আমার গর্ভে তোমার সন্তান। আমাকে মেরে ফেলো না। আমি তোমার পায়ে পড়ছি।
কিন্তু সুদীপ্ত শেষ পর্যন্ত সুপ্রভার গায়ের কাপড়ে আগুন লাগাতে সক্ষম হয়েছে। সুপ্রভা বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে, আর ছুটাছুটি করছে। তাতে ওর শাড়িতে আগুন আরো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠছে।
সুদীপ্ত বাইরে থেকে দরোজা লক করে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি সবকিছু পাথড়ের মতো শক্ত হয়ে দেখছি। কিন্তু যেন কিছুই করতে পারছি না।
তার পর পরই আমার মনে হল আমি সময় নষ্ট করছি কেন? মেয়েটা তো মারা যাবে পুড়ে। এই মুহূর্তে আমার উচিত দৌড়ে গিয়ে বাইরের লক খুলে কোন কম্বল বা কাঁথা দিয়ে সুপ্রভাকে জড়িয়ে ধরে আগুন নেভানো। তারপর না হয় সুদীপ্ত কে আমি দেখে নিব।
আমি ছুটে বের হয়ে আসলাম। ভোরের আজান হচ্ছে। আমি দৌড়ে পাশের বাসার ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করছি। বাসাটা কেমন পুরনো মনে হচ্ছে। মাকড়সার জাল দিয়ে চারদিক ঘেরা। মূল ফটকে জং ধরা তালা। আমি খুব করে তালাটা ভেঙে ফেলতে চাইছি। আমার চারপাশে মুসল্লিদের ভিড় জমছে। যারা নামাজ পড়তে মসজিদে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। আমাদের দারোয়ান ও ছুটে আসলো আমাকে দেখে।
সে ভয়ার্ত চোখে প্রশ্ন করলো, ম্যাডাম আপনি এখানে কি করছেন?
আমার মাথা কাজ করছিল না। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, চাচা তালাটা ভাগুন। ভেতরে সুপ্রভা নামের একটা মেয়ের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে তার পাষন্ড বর। নাম সুদীপ্ত।
আমি খেয়াল করলাম সবার চোখে মুখে বিস্ময় ঝড়ে পড়ছে। আমি বুঝতে পারছি না একজন মানুষ পুড়ে মারা যাচ্ছে আর আপনারা তাকে বাঁচাতে চেষ্টা না করে সবাই আমার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন কেন?
দারোয়ান চাচা মাথা নত করে দুঃখী গলায় যা বললো, তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
ম্যাডাম এই বাসায় পাঁচ বছর আগে সুপ্রভা ম্যাডাম নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করে। তাকে তার বর গান গাইতে দিবে না জন্য মনের কষ্টে আত্মহত্যা করে। এরপর সুদীপ্ত দাদা এই বাসা আরেক জনের কাছে বিক্রি করে ইন্ডিয়া চলে গেছে।
নতুন মালিক কয়েকবার ভাড়া দিছে। কিন্তু কেউ পনেরো দিনের বেশি থাকে না এই বাসায়।
দীর্ঘ দিন ধরে এই বাসা পরিত্যক্ত। এখন কেউ নেই ম্যাডাম। ঐ যে স্যার আসছে।
স্যার ম্যাডামকে বাসায় নিয়ে যান।
আমি কোন কিছুই মেলাতে পারছি না। নিজের চোখে যা কিছু দেখলাম সব জীবন্ত। এরা বলছে পাঁচ বছর আগের ঘটনা এটা। তাহলে কি সুপ্রভা আমার মাধ্যমে দেখানোর চেষ্টা করলো যে ও আত্মহত্যা করেনি। ওকে মেরে ফেলা হয়েছে!
আমি আর কিছু ভাবতে পারছিনা। জাফর উদ্বিগ্ন মুখে আমার কাছে এগিয়ে আসতেই আমি ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারালাম।
পরিশেষে আমি পরের দিন জাফরকে নিয়ে স্থানীয় থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করি। তারপর থেকে আস্তে আস্তে আমার মধ্যে কিছু পাগলামি দেখা দিয়েছে। শহরের সবচাইতে নামকরা সাইক্রিয়াস্টিট ডা: অরুপ রতনের আন্ডারে আমার চিকিৎসা চলছে।
আর ও হ্যা। সেই বাসাটাও আমরা ছেড়ে দিয়েছি ডাক্তারের পরামর্শে।
এখন আমি অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু সময় পেলেই আমি হারিয়ে যাই সেই রহস্যময় রাতের ঘটনায়। দীর্ঘ পাঁচ বছর পর সবকিছু আমার চোখের সামনে কিভাবে এতো জীবন্ত হয়ে ধরা দিল সেটাই একটা আশ্চর্য ঘটনা।
ডাক্তার বলেছে জগতে অনেক রহস্যময় ঘটনা ঘটে। যেসব ঘটনার কোন ব্যাখ্যা হয় না। পুরো ব্যাপারটা প্যারানরমাল সাইকোলজির বিষয়। এবং রহস্যময় জগতের আসাধারণ একটি উদাহরণ
এটাও হয়তো তেমনি একটি ঘটনা!