#ছোটোগল্প ।
#বোধদয়।
-রোকেয়া পপি
আপা তুই কি বোবা কালা?
কেন কি হয়েছে?
তোর ছেলে আর ছেলের বউ কেমন ঝগড়া করছে, তোর কানে কি ঢুকছে না?
তুই এমন নির্লিপ্ত থাকিস কিভাবে!
হ্যা রে, আমি বোবা, কালা।
ওরা দুজনে প্রাপ্ত বয়স্ক। ওরা ঝগড়া করছে সেটা ওদের ব্যাক্তিগত বিষয়। আমি কেন এর মধ্যে নাক গলাব?
কি অদ্ভুত কথা বলছিস আপা।
আমার বাসায় যেয়ে এক সপ্তাহ থেকে আয়। দেখে আয় কিভাবে পুত্র বধূকে হাতের মুঠোয় রাখতে হয়।
আমার সামনে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস তার নেই।
সব কিছু আমার কন্ট্রোলে।
আমার পারমিশন ছাড়া নিজের পছন্দ মত কিছু রান্না করার সাহস ও তার নেই। বিয়ের পর একদিন সে এই সাহস দেখিয়েছিল।
এমন টাইট দিয়েছি, আর জীবনে ও সে নিজের ইচ্ছে প্রতিষ্ঠা করার সাহস দেখাবে না।
প্রতি বেলায় রান্নার আগে আমার কাছে এসে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করে, আম্মা কি রান্না হবে আজ?
এই যে দুই দিন ধরে তোর বাসায় আছি। দেখেছিস, ফোন করে জেনে নেয় রান্না কি হবে।
শান্তার কথার মধ্যে এক ধরনের আত্ম অহমিকা ফুটে উঠেছে আমি আবাক হয়ে দেখলাম।
আমরা দুই বোন।
আমি শায়লা। আমার ছোট বোন শান্তা। আমার খুব আদরের ছোট বোন। বাবা মা মারা যাওয়ার পর ও আমাকেই মায়ের জায়গা টা দিয়েছে।
ওর যখন মন চায় ও আমার কাছে এসে দুই চারদিন থেকে যায়।
আমরা দুই বোন তখন অনেক সুখ দুঃখের গল্প করি।
আমার খুব ভালো লাগে।
ভালো লাগে না শুধু ও সব ব্যাপারে নাক গলাতে চায়।
ওর আর আমার চিন্তা চেতনার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।
সংসারের পুরো কতৃত্ব নিজের হাতের মুঠোয় রাখার মধ্যেই যেন ওর সব সুখ।
আমি হালকা হেসে বললাম।
শোন শান্তা ছেলেটা আমার। আমার কাছে ও সব সময় ছোট্ট একটা বাচ্চা ছেলে। ওকে আমি যেভাবে বকাঝকা করতে পারি, রাগ দেখাতে পারি।
সেটা কি ছেলের বউয়ের সাথে সম্ভব?
কেন সম্ভব নয়?
অন্যায় করার সাথে সাথে ধরবে। শক্ত করে দুটো ধমক দিয়ে বলবে, তোমার এতো বড় সাহস!
তুমি আমার সামনে আমার ছেলের সাথে গলা উঁচু করে কথা বলো। এর পর যদি আর কখনো এভাবে কথা বলতে দেখি, গলার তার এক টানে ছিঁড়ে ফেলবো।
দেখবে আর সাহস পাবে না কখনো আমাদের ছেলের সাথে এমন ঝগড়া করার।
শান্তা আমার মনে হয় তুই ভুল করছিস।
বউমা অন্য বাড়ির মেয়ে।
সে তো আমার মেয়ে নয়। আর আমি তাকে কখনোই নিজের মেয়ে মনে করি না।
সে আমার বন্ধুর মতো। বউমার সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধুত্ব পূর্ণ।
আমি যদি তাকে বকা দেই সে কিন্তু এই বকার কথা আজীবন মনে রাখবে। কখনো ভুলবে না।
তাকে বকা দিবে তার জ্ন্ম দাত্রী বাবা মা।
অথবা তার স্বামী।
আমি মনে করি একসাথে থাকলেই সব বিষয়ে নাক গলাতে হবে তা নয়।
বরং অনেক কিছু দেখেও না দেখার ভান করলে সংসারে শান্তি বজায় থাকে।
এই যে দেখ, আমার বউ মা বেতন পেয়ে আমার কাছে আগে আসে। বিয়ের পর প্রথমবার পুরো বেতনের টাকা সে আমার হাতে তুলে দিতে চাইছিল।
আমি সুন্দর করে বুঝিয়ে তাকে ফেরত দিয়েছি।
এতে কি ও খুশি হয়নি।
বেতন পেয়েই ও আমার কোন খাবারটা পছন্দ সেটা কিনে নিয়ে ঘরে ফিরে।
তার মায়ের জন্য যখন যা কিনে তা ডাবল কিনে।
আমাকে আর তার মাকে সবকিছু একরকম কিনে দেয়।
অফিসের কাজে যখনি দেশের বাইরে যায়, আমার জন্য কতোকিছুই না নিয়ে আসে।
এগুলো তো ভালোবাসা থেকে আনে তাই না?
আমার সাথে যদি ওর সম্পর্কটা ভয়ের হতো, তাহলে কি আমি ওর এতো ভালোবাসা পেতাম?
ওর বাচ্চাটাকে যে তুমি সারাদিন দেখভাল করো।
সেটা কিছু না?
বাচ্চা কে ভালবাসো, যত্ন আত্তি করো বিধায় সে তোমার জন্য মন খুলে খরচ করে।
বিনে পয়সায় বাচ্চা দেখার জন্য এমন বিশ্বস্ত লোক পাবে কোথায় শুনি?
আবারও তুই ভুল বলছিস।
আমার নাতিকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার।
এর জন্য আমি কোন বিনিময় আশা করি না।
ঠিক সেই সময় আমার বউমা অর্পিতা চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে বাইরে থেকে নক করলো, মা আসবো?
এসো বউমা।
মা আপনাদের চা এখানে দিয়ে গেলাম। আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি আসি মা।
রহিমা খালাকে সব বুঝিয়ে দিয়েছি, কি কি রান্না করতে হবে।
আচ্ছা ঠিক আছে মা তুমি এসো।
অর্পিতা বের হবার সময় খেয়াল করলো, টুকটুকি ফ্লোরে বসে খেলছে আপন মনে।
ও টুকটুকিকে চোখ গরম করে বললো, আবার ফ্লোরে বসেছো?
তোমাকে না বলেছি দিদার পাশে বসে খেলতে।
ঠান্ডা লাগলে কে দেখবে শুনি?
ও কোলে করে আমার পাশে টুকটুকিকে রেখে অফিসে চলে গেল।
অর্পিতা বের হওয়ার সাথে সাথে শান্তা বললো, আপা তুমি এখনো কিছু বললে না!
সারাদিন দেখাশোনা করো তুমি। আর তোমার সামনে বাচ্চা কে এভাবে ধমক দিয়ে কথা বলে!
শোন শান্তা টুকটুকি কে জন্ম দিয়েছে অর্পিতা।
বাচ্চাকে শাসন এবং আদর করার সম্পূর্ণ অধিকার ওর আছে।
আমি কেন এর মধ্যে কথা বলবো।
আর তোকে ও বলছি।
সব সময় তো শুধু নিজের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা শিখেছিস।
এখন থেকে ছেলের বউকে একটু ভালোবাসা, একটু স্বাধিনতা দে।
ধমকা ধমকি না করে একটু আদর স্নেহ করে কথা বলে দেখ।
সম্পর্কটা অনেক সহজ হবে।
ছেলের বউ কেন তোকে ভয় পাবে?
তার সাথে তোর সর্ম্পক হবে ভালোবাসার।
তোর কি ইচ্ছে করে না ওদের ভালবাসা পেতে?
আপা তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছো।
আমি কখনো এভাবে ভাবিনি।
সবসময় ভেবেছি সবাই আমাকে ভয় করবে। পুরো কতৃত্ব থাকবে আমার হাতে।
ভালোবাসা পাওয়ার সামান্য চেষ্টা আমি কখনো করিনি।
আপা আজ আমি যাই আপা।
আমি আজকে থেকেই আমার বউমাকে ভালোবাসবো।
ও যা করতে চায় করতে দিব।
এখন যাবি কিরে?
খাওয়া দাওয়া করে বিকেলে যাবি।
না আপা আমি এখনি যাবো।
ভুল যখন ধরতেই পেরেছি, তখন আর দেরি কেন?
আজকে থেকেই শুরু হোক আমার নতুন পথ চলা।
আমি এখানে বসেও বাসায় কি রান্না হবে সেই আদেশ দেই।
দুটো দিন ওদেরকে ওদের মতো থাকতে দেই না।
কতো অধম আমি।
এর মধ্যে শান্তার ফোনটা বেজে উঠলো।
ও হ্যালো বলে ওপাশের কথা শুনলো।
তারপর ছলোছলো চোখে বললো, বউমা আজকে তুমি তোমার পছন্দমত রান্না করো।
যা মন চায় ঠিক তাই করো মা।
আমি আসতেছি।
দুপুরে তোমার সাথে বসে তোমার পছন্দের রান্না তরকারি দিয়ে ভাত খাবো।
আজ আমার বড্ডো বেশি ভালো লাগছে।
আমার এই আত্ম অহংকারী বোনটা অনেক দেরিতে হলেও তার ভুল বুঝতে পেরেছে।
ওর মুখে এক ধরনের প্রশান্তি খেলা করছে।
আর চোখ দুটো পানিতে টলমল।
ওর ভাললাগা টুকু যেন আমাকে ও ছুঁয়ে গেল।
আনন্দে আমার চোখ দুটো ও ভিজে উঠছে।