বিরুলিয়া শতবর্ষী বট গাছের অজানা কথা।
বিভিন্ন জায়গায় জানা ও অজানা কাহিনী গুলো জানতে ও জানাতে আমার খুব ভাল লাগে, এটা আমার এক রকম নেশা বললেই হয়, তাই ছুটে যাই আশেপাশের জায়গা গুলোতে, তাঁদের ইতিহাস জানতে, সেই সব অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি জায়গার পরিচিতি আমি আজ তুলে ধরব,
ঢাকার খুব কাছেই তুরাগ নদীর পাড়ে একটি গ্রাম, বলছি বিরুলিয়া গ্রামের কথা, অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম, বিরুলিয়া গ্রামে যাব, আর সেখানকার পুরনো ঐতিহ্য গুলো দেখে আসব।
তুরাগ তীরের ছোট্ট জনপদ বিরুলিয়া, ঢাকার পাশেই অবস্থিত গ্রামটি। এখানে জমিদার বাড়ি রয়েছে অনেক, তবে বিরুলিয়ার জমিদার বাড়ির কথা অনেকেই জানেন,
এখানে রয়েছে বিরুলিয়ার বিখ্যাত জমিদার রজনীকান্ত ঘোষের বাড়ি। কথিত আছে তৎকালীন সময়ে মালিক নলিনী মোহন সাহার নিকট থেকে কেনা হয়েছিল মাত্র ৮৯৬০ টাকা ৪ আনা দিয়ে।
জমিদার বাড়িটি ঘুরতে ঘুরতে কথা হল স্থানীয় অনেকের সাথেই, স্থানীয়দের কাছে আরও একটি বিষয় জানতে পারলাম যেটা আমার কাছে ছিল সম্পূর্ণ অজানা, সেটা হচ্ছে বিরুলিয়ার প্রাচীন বট গাছ, খুব আগ্রহ করে সেখানে যেয়ে দেখি তুরাগ নদীর মধ্যে একটি দ্বীপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন বট গাছটি, বর্ষা কালে প্রধান তুরাগ নদী থেকে পানি এসে এই জায়গাটা চারপাশ ডুবে যায়,
আমার জন্ম ঢাকায়, নদী পাড়ের মানুষ আমি নই, সাতার তো দুরের কথা, পানির কাছে যেতেও ভয় লাগে… কিন্তু সেদিন চিন্তা করলাম এসেছি যখন, তখন তুরাগ নদীর পানি পার করেই বট বৃক্ষের কাছে যাব…। যেই ভাবা সেই কাজ … বট গাছের চার পাশ কোথাও কোমর পানি আবার কোথাও হাঁটু পানি, আমিও আমার স্থানীয় গাইড কে নিয়ে খোঁজ করছিলাম, কোথায় অল্প পানি রয়েছে …তবে পুরোপুরি বর্ষায় এই জায়গা পুরোই ডুবে যায় , তখন নৌকা ছাড়া যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব না।
অবশেষে পেয়ে গেলাম, কিছুটা হাঁটু পানি পার হয়ে যেতে হয় সেই জায়গা, স্থানীয় গাইড বললেন, এই জায়গাটা একেবারে নিরব আর এখানে সাপের উপদ্রপ থাকতে পারে…। আমি চিন্তা করলাম আজ যেভাবেই হউক আমি যাব সেই জায়গায়… পায়ের জুতো খুলে হাতে নিলাম, আমার সাথে আরও দুইজন, ধীরে ধীরে পানিতে নামলাম… মনে হচ্ছিল পানি গভীর হচ্ছে… এদিকে মাঝ বরাবর আসতেই কোথায় উঁচু আবার কোথাও গর্তের মতো জায়গায় পা পরল। অবশেষে পার হলাম সেই বিখ্যাত শতবর্ষই বট গাছের কাছে , স্থানীয় গাইড বলল, “এখানে পাশেই রয়েছে শ্মশান ঘাট” যাই হউক এই বট গাছটির রয়েছে এক সুন্দর ইতিহাস, যেটা অনেকেই জানেন না ,
স্থানীয়দের কাছে যতটুক জানতে পারলাম, সেটা হচ্ছে, তৎকালীন জমিদারদের পাশাপাশি অনেক বিত্তশালি ব্যবসায়ীরা এখানে ব্যবসা করতেন, এঁদেরই একজন ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের নিকট ‘ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়’ – এর মালিক বাবু নিতাই লাল সাহা।
দেশ ভাগের পরপর তিনি চলে যান কলকাতাতে, সাথে নিয়ে যান তুরাগ তীরের এই বট বৃক্ষের ছবিটি। কারন ঢাকার বিরুলিয়ার এই বটবৃক্ষের নিচে বসেই সকাল সন্ধ্যা পূজা অর্চনা করতেন বাবু নিতাই লাল সাহা।
গ্রামের বিশ্বস্ত নির্ভরযোগ্য কয়েকটি পরিবার আর দোকানের কর্মচারীদের তার সাথে নিয়ে যান ।
কোলকাতায় যেয়েই নূতন করে শুরু করেন কাপড়ের ব্যবসা। সেখানে তিনি খ্যাতি অর্জন করে গোটা কোলকাতায়। পূর্ব পুরুষের এই ব্যবসা ক্রমে ক্রমে প্রসার লাভ করে ভারতের বিভিন্ন শহরে।
এখন তাঁরই উত্তরাধিকারীরা দাপটে এখনো ধরে রেখেছেন এর সুনাম। বিরুলিয়ার স্থানীয়দের কাছে জানা গেল বর্তমানে কোলকাতার গড়িয়াহাট রাসবিহারী এভিনিউতে ‘আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয়’ নামের এই প্রতিষ্ঠান সেখানে রয়েছে। জন্মভুমির স্মৃতিচিহ্ণ বিজড়িত বিরুলিয়ার এই বট বৃক্ষ হচ্ছে তাঁদের আস্থা ও আত্ম বিশ্বাসের প্রতিক।
কলকাতার দোকানের ক্যাশ কাউন্টারের মাথার উপর এখনো নাকি রাখা আছে বিরুলিয়ার এই বট গাছের বাঁধানো ছবিটি। বংশ পরম্পরায় চলমান প্রথায় এই ছবিতে ধুপ দিয়ে শুরু হয় দিন।
শেকড় নেমে কান্ডে পরিণত হয়ে ছড়িয়েছে গাছটি। প্রতি বৎসর পহেলা বৈশাখে মেলা ছাড়াও পূজা অর্চনা লেগে থাকে এই বট তলে।
ইতিহাস গুলো জানতে পেরে আমার খুবই ভাল লাগলো, অবশেষে আমাদের ফেরার পালা।। স্থানীয় গাইডদের ধন্যবাদ দিয়ে আবার তুরাগ নদীর পানি ভেঙ্গে পার হয়ে এলাম ঢাকার দিকে ফেরার উদ্দেশে… ফিরে আসার সময় জমিদার বাড়ি গুলো আবারও চোখে পড়ল , আর ফেরার সময় ভাবছি , এক সময় কত দাপট এর সাথে থাকতেন জমিদাররা, কালের বিবর্তনে এখন এখানে কেও নেই। পড়ে রয়েছে শুধু তাঁদের বাড়িগুলো ।। জরাজীর্ণ এই বাড়িগুলো এক সময় পরিপূর্ণ ছিল আভিজাত্যে ও জৌলুসময়ে। আসলে সময় এরকমই… সব কিছু শেষে সময় জিতে যায় আর আমরা হারিয়ে যাই সময়ের অতল গভীরে…।
লেখক: মোহাম্মদ সোহেল রানা