সেই অভিশপ্ত বাড়ি
********************
মুম্বাইয়ের একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী পেয়েছে শাবানা, ওদের আদি বাড়ি কলকাতার ভবানীপুর
অঞ্চলে,সেখানে শাবানার মা,বাবা আর ছোটভাই আবিদ থাকে।এই চাকরীটা পাওয়ার পর শাবানার বাবা ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে ওর অফিসের কাছের একটি এপার্টমেন্টের একটি 1BHK ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে শাবানার থাকার ব্যবস্থা করেন।ওই ফ্ল্যাটে শাবানা একাই থাকবে তাই ওর বাবা ওর প্রয়োজনীয় সব রকমের জিনিসপত্র কিনে ফ্ল্যাট টা সাজিয়ে দিয়ে উনি কলকাতায়ে ফিরে আসেন।
কিছুদিন অফিস যাতায়াত করার পর শাবানার বেশ কয়েকজন বন্ধু বান্ধব হয় তাদের সাথে প্রায়ই উইকএন্ডে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে বেড়াতে যায় শাবানা। শাবানা খুবই সাহসী মানসিকতার মেয়ে
একটু ডাকাবুকো টাইপের,কোনো কিছু তেই তার ভয় নেই।এই অফিসের একটি মেয়ের সাথে খুবভাল সম্পর্ক হয়ে গেছে শাবানার,তার নাম শবনম।প্রায়ে শাবানা ওর বাড়িতেও যায়,শবনম এর মা ওকে খুবই স্নেহ করেন,ওনার খুব ইচ্ছা ওনার ছেলে শামীমের সাথে বিয়ে দিয়ে বউমা করে ঘরে আনবেন এই মেয়েকে।
শবনমদের বাড়ির কাছেই একটি বাড়ি আছে,বাড়িটি ইনকমপ্লিট একটি বাড়ি, ওই বাড়িটি তৈরি হওয়ার সময় কি সব যেন হয়েছিলো,তারপর আর ওই বাড়ি টি তৈরি করা হয়নি,তিনতলা বাড়ি কিন্তু
ইনকমপ্লিট।সবাই বলে ওই বাড়িতে নাকি এক ভয়ানক দুরাত্মার বাস,কেউ ওই বাড়িতে ঢুকলে তার মৃত্যু অবধারিত ওই বাড়িটি অভিশপ্ত বাড়ি।তাই কেউ ওই বাড়িতে ভুলেও ঢোকেনা।শাবানা এইসব কথা বিশ্বাস করেনা, বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে সে,”দেখবি তোরা?আমি ঐ বাড়িতে ঢুকে বেরিয়ে আসবো, আমার কিচ্ছু হবেনা,যত সব কুসংস্কার, আমি এইসব মানিনা”,বাজি ধরে শাবানা , একদিন দুপুরে ঐবাড়ির ভেতরে ঢুকলো
সিঁড়ি দিয়ে গটগট করে উঠেগেল ওপরে কিছুই দেখতে পেলোনা সে,ছাদে উঠে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে জোরে চিৎকার করে বললো , আমি ছাদে উঠে গেলাম এখনো আমার কিছুই হলোনা,এবার আমি নিচে নেমে আসছি,বলে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলো সে,ছাদ থেকে তিনতলায় নেমে এলো শাবানা,পরিষ্কার জায়গা কোথাও কিচ্ছু নেই,এবার দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে একটা কান্নার শব্দ শুনতে পেল,একটু এগিয়ে গিয়ে দেখল,
সিঁড়ির মুখে একটি মেয়ে বসে হাঁটুতে মাথা গুঁজে কাঁদছে,শাবানা তার কাছে গিয়ে বলল,”এই কে তুমি?কাঁদছো কেন?”মেয়েটি কোনো কথা বলেনা, শুধু কেঁদেই যায়,ওকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে থাকে শাবানা, নীচের তলার সিঁড়ির কাছে এসে গায়ের রক্ত হিম হয়ে যায় ওর,দেখে সেই মেয়েটিই নীচের সিঁড়িতেও একইভাবে বসে বসে কাঁদছে,মনে মনে ভাবে শাবানা, মেয়েটি কি করে এখানে এলো?ও তো ওপরের সিঁড়িতে ছিল!এবার আর কোন কথা না বলে শাবানা ওকে পাশ কাটিয়ে নীচে নামতে যায়,মেয়েটি দুইহাঁটুর ভাঁজথেকে মুখ তুলে তাকায়, কি বীভৎস সাদা মুখ, আর কি ভয়ানক চোখের দৃষ্টি তার।এক ছুটে ওই বাড়িথেকে বাইরে বেরিয়ে আসে শাবানা।বন্ধুদের কোনো কথা বলেনা সে।এরপর যে যাঁর বাড়ি ফিরে যায়।নিজের ফ্ল্যাটের পাঁচ তলায় থাকে শাবানা, লিফটে করে ওপরে উঠে যায় ঘরে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে এককাপ কফি বানিয়ে টিভিটা চালিয়ে বসে,একটা মুভি চালিয়ে দেখতে থাকে।
সব কিছুই নরমাল,ওই বাড়িতে যাওয়ার জন্য কোনো সমস্যাই হয়না তার,তবে ঐ মেয়েটিকে দেখে খুব ভয় পেয়েছিল সে। রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়লো শাবানা।কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিল জানেনা সে, একটা অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে গেল তার,মোবাইল টিপে দেখলো রাত তখন 3.15 পাশ ফিরে শুলো সে,হলের দিকে চোখ গেল ওর দেখলো সেই মেয়ে টি ওখানে দাঁড়িয়ে অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,চিৎকার করে উঠে বসলো শাবানা,বেড সাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিয়ে দেখলো কোত্থাও কেউ নেই,শাবানা ভাবলো সবটাই ওর মনের ভুল,তাই আবার শুয়ে ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলো সে।কিন্তু কিছুতেই ঘুমোতে পারলনা, সেই মেয়েটা এবার খিলখিল করে হেঁসে উঠলো,ভয়ানক ধাতব গলায় বলল,”কেন গিয়েছিলে ওই বাড়িতে?জানোনা আমি পছন্দ করিনা কেউ যাক ওখানে,আমিতো নিজে থেকে এখানে আসিনি,তুমিই নিয়ে এসেছো আমায়”।এই কথা বলে বিশ্রী ভাবে হেঁসে ওঠে সে।ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় শাবানার শিরদাঁড়া বেয়ে।তার মতো সাহসী মেয়েও ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপতে থাকে,মনেহয় এইরাত যেন শেষ হচ্ছেনা,কোনো রকমে উঠে ঘরের সব কটা লাইট জ্বালিয়ে দেয় সে।মেয়েটিকে আর দেখতে পায়না শাবানা,কোন ভাবে
ভোর হওয়া মাত্রই শবনম কে ফোন করে আসতে বলে,শবনম আসার পর ওকে সব কথা খুলে বলে,সবকথা শুনে শবনম বলে আজ অফিস থেকে সোজা আমাদের বাড়ি যাবি,এখন বাড়িতে আমি আর আমার ভাইয়া আছি,আম্মু আর আব্বু কদিনের জন্য ঘুরতে গেছে,
তুই এখন আমাদের সাথেই থাকবি,পরে
আম্মুরা আসলে একটা ব্যবস্থা করা যাবে।সেদিন তৈরি হয়ে ওরা দুজন এক সাথেই অফিস বেরিয়ে যায়।সারাদিন আর কোনো ঘটনা ঘটে না,একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে শাবানা।অফিস ছুটির পর শবনম এর সাথে ওর বাড়ি চলে যায় ওরা দুজন,আট তলায় থাকে ওরা তাই লিফটে ওঠে ওপরে যাওয়ার জন্য, লিফ্ট থেকে বেরিয়েনিজেরফ্ল্যাটের দরজার দিকে এগিয়ে যায় শবনম,ওর ভাইয়া এখনো ফেরেনি তাই দরজায় তালা দেওয়া আছে,ব্যাগ থেকে চাবি বেরকরে তালা খুলতে থাকে শবনম,আর শাবানা
লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে দেখে লিফটের দরজাটা খানিকটা খোলা,আর ধাতব আওয়াজে লিফ্ট থেকে সমানে বলে চলেছে ” Please close the door”. “Please close the door”.ওরা বেরিয়ে তো দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলো তা হলে ওটা খুললো কিভাবে?হঠাৎ ঘটাং করে একটা আওয়াজ হলো আর লিফটের দরজাটা নিজেই বন্ধ হয়ে গেল।বিস্ফারিত চোখে এই দৃশ্য দেখে দৌড়ে শবনম এর কাছে পালিয়ে এলো শাবানা।ভেতরে ঢুকে দুজনেই ফ্রেশ হয়ে নিয়ে ব্যালকনিতে বসে কফি খেতে লাগলো,লিফটের ঘটনাটা বন্ধুকে বলল
শাবানা, ওর কথা শুনে শবনম বললো ওটা তোর মনের ভুল,আমরা নামার পর তো লিফটটাও নিচে নেমে গেল,তাছাড়া লিফটের দরজা বন্ধ না হলে তো ওটা চলবেই না আর সমানে বলবে,”Please close the door.” শাবানা বললো হ্যাঁ রে বলছিলো তো তুই শুনিসনি?অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে শবনম বললো
কাল ওই বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর থেকে তোর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে,মনের ওপর খুব বেশি চাপ নিয়ে ফেলেছিস তুই,ভাইয়া এসে গেলে খেয়ে নিয়ে তুই তাড়াতাড়ি শুয়ে পর,ঠিক মতো ঘুমোলে
তোর সব স্ট্রেস কেটে যাবে।
কিছুক্ষন বাদে শামীম ফিরে আসে,ওরা তিনজন খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে,একটা ঘরে শাবানা আর শবনম শোয়ে,আর একটা ঘরে শামীম শুয়ে পড়ে।মাঝরাতে শাবানার ঘুমটা ভেঙে যায়,ওকে টয়লেট
যেতে হবে,বিছানা থেকে নেমে একাই ও টয়লেটে যায়,ওখান থেকে বেরিয়ে ফ্রীজের কাছে গিয়ে জলের বোতল বের করার জন্য ফ্রিজের দরজা খুলেই ও একটা বিকট চিৎকার করে ওঠে, ফ্রিজের ভেতরে সেই সাদা মুখ মেয়েটা বসে আছে,ধপাস করে দরজাটা বন্ধ করে দেয় শাবানা, ওর চিৎকার শুনে ছুটে আসে শবনম আর শামীম,ভয়ে কাঁপতে থাকা বন্ধুকে তুলে ঘরে নিয়ে যায় ওরা,জোর করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করে শবনম,
কিছুক্ষন বাদেই শাবানা ঘুমিয়ে পড়ে,ও ঘুমানোর পর শবনম ও ঘুমিয়ে পড়ে, কিছুক্ষণ বাদে শাবানার ফোনটা বেজে ওঠে,ঘুম চোখে তাকিয়ে ও দেখে শামীম ফোন করেছে,ঘুম জড়ানো গলায় ও হ্যালো বলে,ওপাশ থেকে শামীম বলে তোমাকে আমি খুব ভালোবাসি,আমার বাড়ির লোকেরাও চায় আমাদের বিয়ে হোক,তোমার কোনো আপত্তি নেই তো?
শাবানা চুপ করে থাকে,শামীম বলে আমি এখন ছাদে আছি,তুমিও চলে এসো গল্প করবো দুজনে,শাবানা মন্ত্র মুগ্ধের মতো উঠে মেন গেট খুলে ছাদে উঠে যায়,ছাদে গিয়ে দেখে ওখানে কেউ নেই,শামীম কে খুঁজতে থাকে শাবানা, ওর ফোনটা হঠাৎ বেজে ওঠে,ওপাশ থেকে শামীম বলে,সামনের দিকে তাকিয়ে দেখো, আমি এই বাড়ির ছাদে আছি,শাবানা দূরের সেই ইনকমপ্লিট বাড়িটার ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখে ওখান থেকে শামীম ওকে হাত নেড়ে ডাকছে,এক ছুটে ছাদ থেকে নেমে,লিফ্ট
এর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে “G” বোতামটা প্রেস করে দেয় সে,ঘরঘর করে নিচে নেমে আসে লিফ্টটা,শাবানা দেখে বড় গেটটা খোলা, দারোয়ান টুলে বসে ঝিমাচ্ছে,এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে ওই বাড়িটার দিকে ছুটে যায় শাবানা, লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে যায় ছাদে,সেখানে শামীম দাঁড়িয়ে দুইহাত বাড়িয়ে দেয় ওর দিকে,শাবানা ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর চওড়া বুকে,কিছুক্ষন পর ওর সম্বিৎ ফেরে তাকিয়ে দেখে ছাদের একটা পিলারকে জড়িয়ে ধরে আছে সে,আর একটু দূরে বসে শামীম আর ওই সাদা মুখের মেয়েটা হাঁটুতে মাথা গুঁজে বিকট শব্দে কাঁদছে! এক হ্যাঁচকা টানে শামীম কে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয় শাবানা,দুজনে ছুটতে থাকে ছাদের কার্নিশের দিকে,পেছন পেছন ওই মেয়েটিও আসতে থাকে,তার কবল থেকে বাঁচার জন্য ওরা দুজন ঝাঁপ মারে ওই চার তলার ছাদ থেকে।পরের দিন সকালে ওই অভিশপ্ত বাড়ির নিচ থেকে শামীম আর শাবানার দেহ পাওয়া যায়।
শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায় ওদের জীবন।।
সমাপ্ত
লেখনী:- স্নিগ্ধা চক্রবর্তী।
কলকাতা , ভারত
দুর্দান্ত লাগলো👌